আমিনুল ইসলাম বকুল: বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস মূলত তামাকজাত পণ্যের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য উৎসর্গীকৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো বিশ্বে তামাক দ্বারা সৃষ্ট রোগ এবং মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসটি তৈরি করেছিল। শুধু তা-ই নয়, এ দিনের উদ্দেশ্যটি হলো তামাক সেবনের ক্ষতিকারক অভ্যাস ত্যাগ করতে সহায়তা করাও। এর অর্থ হলো বয়স্ক সমস্ত লোককে সিগারেট, বিড়ি বা তামাকের সঙ্গে জড়িত ধূমপানের অভ্যাস গ্রহণে নিরুৎসাহিত করা। তামাক প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটায়।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও বিশ্বব্যাপী দিবসটি গতকাল পালিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাবিøউএইচও) এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য করেছে ঞড়নধপপড়’ং ঞযৎবধঃ ঃড় ড়ঁৎ বহারৎড়হসবহঃ অর্থাৎ তামাক আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকি। বাংলাদেশ প্রক্ষাপটে এর ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘তামাকমুক্ত পরিবেশ, সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশ’।
বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের কথা বললেই স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব ধূমপানমুক্ত দিবসের কথা মনে আসে। আমরা ভাবি, কীভাবে লাখ লাখ নারী-পুরুষকে ধূমপান বন্ধ করতে উৎসাহিত করা যায়। কারণ তামাক ব্যবহারের প্রধানতম উপায় হলো ধূমপান। ধূমপানের মূল সমস্যা হলো তামাক জ্বালানো তামাক নয়। একটি সিগারেট জ্বালানো হলে তামাক জ্বলতে থাকে এবং ধোঁয়া তৈরি হয়, যাতে উচ্চ স্তরের ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা ধূমপান সম্পর্কিত রোগগুলোর প্রাথমিক কারণ। জ্বলন্ত সিগারেট-বিড়ি থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া অধূমপায়ীর ফুসফুস ক্যানসার, হার্টের অসুস্থতা এবং হতাশাসহ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কারণ হতে পারে। আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি বলছে, ধূমপায়ীদের যখন পরোক্ষ ধূমপানের ধোঁয়া বা পরিবেশগত তামাকের ধোঁয়ায় আক্রান্ত করা হয়, তখন এটিকে অনৈতিক ধূমপান বা নিষ্ক্রিয় ধূমপান বলে।
তামাক ও তামাকজাতদ্রব্য চাষ, বিপণন ও গ্রহণ এর সর্বস্তরে পরিবেশকে দূষিত করে ফেলে। তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। তামাক উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাষক ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত সার ও কীটনাষক মাটির স্বাভাবিক সক্ষমতা নষ্ট করে। বৃষ্টির পানিতে সার ও কীটনাষক ধুয়ে নদী বা খালের পানিতে মিশে। যার ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তামাক চাষ ও পরিচর্যায় নিযুক্ত শ্রমিক ও কৃষকদের বিষাক্ত তামাকপাতার সংস্পর্শে বারবার আসার ফলে নানা ধরনের চর্মরোগ তৈরি হয়। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। নারী ও শিশুরা তামাকপাতা উত্তোলন ও শুকানোর কাজে নিয়োজিত থাকে। তামাকপাতা শুকানোর কাজে বিশেষ করে তামাকপাতা সাজিয়ে একটানা তাপ বজায় রাখতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন কাঠ। কৃষকরা এ সময় বিপুল কাঠের জোগান নিশ্চিতে প্রচুর গাছ-পালা কেটে আনে, যার ফলে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দেয়। সিগারেট বিড়ি উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে তামাকের গুঁড়া বাতাসের সঙ্গে মিশে বায়ু দূষিত করে। তামাক গাছের গোড়া মাটির সঙ্গে মিশে মাটির স্বাস্থ্যকে নষ্ট করে। সিগারেটের বাঁট অপচনশীল প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি সিগারেটের বাঁট মাটি বা পানির সঙ্গে মিশে পরিবেশ দূষণ করে চলেছে।
আইন অনুসারে, গণপরিবহন যেমন মোটর গাড়ি, বাস, ট্রেন, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, সব ধরনের যান্ত্রিক গণপরিবহন, বিমান এবং অন্যান্য যেকোনো পরিবহন সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বা ঘোষিত হয়। আইনের ওপর ভিত্তি করে, এই ধরনের পরিবহনগুলো ধূমপানমুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবে, গণপরিবহনে ধূমপান চলছে এবং মাঝেমধ্যে অসহনীয় হয়ে ওঠে। গাড়ি চালনাকালে চালক এবং তার সহকারী প্রকাশ্যে সিগারেট টানে, যা যাত্রীদের জন্য বিরক্তির উদ্রেক করে। রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে ধূমপান করা একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রীরা বাসে ধূমপান না করলেও, চালক ও তারা সহকারী প্রায়ই ধূমপান করে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, পরিবহনশ্রমিকদের ৬২ শতাংশ এখনও গণপরিবহনে ধূমপান করে থাকে। বাসে ধূমপান করলে ২৯ শতাংশ যাত্রী প্রতিবাদ করেন। এ ছাড়া গণপরিবহনের ৬১ শতাংশেই এখন পর্যন্ত ধূমপান বিরোধী স্থায়ী সাইনেজ নেই। জনস্বার্থেই সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসরণ করে সব ধরনের জনসমাগমের স্থান এবং গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনটি মানা হয় না। কখনও যাত্রীদের হাতে সিগারেট জ্বালিয়ে যাত্রী বিশ্রামাগারে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় দেখা যায়, যা ধূমপান না করা অন্যান্য যাত্রীর জন্য অস্বস্তিকর ও ক্ষতিকর। এটি বেশিরভাগ যুবক বা মধ্যবয়সী নাগরিকরা করেন এবং তাদের শিক্ষিতও বলে মনে হয়।
সরকার একদিকে যেমন সর্বজনীন স্থানে তামাক ব্যবহারের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে লঙ্ঘনকারীরা তাদের আচরণে আগ্রাসী এবং এভাবে সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সর্বত্র উপেক্ষা করছে। এছাড়া যাত্রীরা যখন ড্রাইভার এবং সহযোগীদের ধূমপান বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন, তখন তারা যাত্রীদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়। অনেক সময় প্রতিবাদকারী যাত্রীরা ড্রাইভার এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। এসব ধূমপায়ী লোকদের এবং ড্রাইভার ও তাদের সহযোগীদের পরিবহনে ধূমপান থেকে বিরত রাখতে আইন প্রয়োগকারীদের সহায়তা অত্যন্ত জরুরি।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৯ এবং ১৪ ধারায় বলা আছে যে, কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ঘটনা পরিদর্শন সাপেক্ষে লিখিত মামলা করতে পারবে এবং শুধু নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জরিমানা করতে পারবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে ঠিকমতো আইনটি প্রয়োগই হচ্ছে না।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা উচিত। বিশেষ করে বাস টার্মিনালগুলোতে এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা না বললেই চলে। এমনকি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের কোনো প্রকার নজরও নেই বলা যেতে পারে। অথচ প্রতিদিনই অসংখ্য যাত্রীরা শিকার হচ্ছেন পরোক্ষ ধূমপান দ্বারা, যার ফলে তারা নানাবিধ অসুখে পতিত হচ্ছে। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে প্রয়োজনে অন্য কোনো বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করে হলেও রাজধানীর বাস টার্মিনাল এবং গণপরিবহনগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়াও পরিবহন সংস্থাসহ বিআরটিএ, বিআরটিসি, বিআইডবিøউটিএ এবং পুলিশ বিভাগকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ড্রাইভারও তাদের সহযোগীদের পরিবহন সংস্থার নির্দেশনার পাশাপাশি বিআরটিএকে পরিবহনের ফিটনেস প্রদানের সময় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রতিপালনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হওয়া, বিআরটিসিকে ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণকালীন ধূমপান বন্ধে উদ্বুদ্ধকরণসহ বাস ধূমপান রাখতে কঠোর নির্দেশনা প্রদান এবং পুলিশ বিভাগকে আইন লঙ্ঘনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সক্রিয় হওয়া জরুরি।
গ্যাটস সার্ভে ২০১৭ অনুসারে, বাংলাদেশে এখনও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার ৩৯% মানুষ এর মধ্যে অধিকাংশই শিকার হয় পাবলিক প্লেসে। বিশেষকরে মানুষ যখন যাতায়াতের জন্য বাসÑলঞ্চ ব্যবহার করে এবং টার্মিনালগুলোতে যখন সবাই অবস্থান করে, ডাস্ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, টার্মিনালের শতকরা ৬৮ ভাগ দোকানেই তামাকজাত পণ্য বিক্রি করা হয়, যার মধ্যে একটি দোকানেরও তামাকপণ্য বিক্রয়ের কোনো প্রকার লাইসেন্স নেই। টার্মিনালগুলোর সার্বিক পরিবেশ উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব টার্মিনাল গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। টার্মিনালগুলোয় যত্রতত্র থুতু ও কফ ফেলা, পানের পিক ফেলা খুবই সাধারণ বিষয় এবং তামাকজাত দ্রব্য এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে টার্মিনালের পরিবেশ উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, ইজারাদার, বাস-মালিক কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন একসঙ্গে সমবেতভাবে কাজ করতে হবে। এর পাশাপাশি টার্মিনালগুলোতে বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের জন্য পয়েন্ট অব সেল কমাতে হবে। মোবাইল ভেন্ডরদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। তামাক বিক্রয়ে আলাদা বিক্রয় লাইসেন্স আরোপ করতে হবে। টার্মিনালগুলোর পরিবেশ উন্নয়নে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বিআরটিএ ও বিআইডাবিøউটিএ’র এনফোর্সমেন্ট শাখাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে এবং ট্রাফিক সার্জেন্টদের জরিমানা আরোপের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
আমরা মনে করি, বিআরটিএ, বিআরটিসি, বিআইডবিøউটিএ-সহ অন সহযোগী সংস্থাগুলো যদি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে তদারকি জোরদারকরণ এবং সে অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে আমরা খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে গণপরিবহনকে ধূমপানমুক্ত করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।
উপদেষ্টা
ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্টিভিটিস অব সোসাইটি-ডাস্।