বিদেশে বাংলাদেশিদের অবৈধ বিনিয়োগ ৩,২৫০ কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী ও জয়নাল আবেদিন: সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ কয়েক বছর ধরে প্রকাশ করছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি। আমদানি-রপ্তানিতে মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার করা হয়। এছাড়া সরাসরি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগও রয়েছে। এর বাইরে বাংলাদেশিরা বিদেশে অবৈধভাবেও বিনিয়োগ করে চলেছে। যদিও বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশিদের বিদেশে অবৈধ বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৫ কোটি ডলার, যা বৈধ বিনিয়োগের প্রায় ৯ গুণ। প্রতি বছরই এর পরিমাণ বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বা মানি লন্ডারিং ইস্যুতে কাজ করা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিষয়টি জানে না।

সূত্রমতে, বিদেশে বিনিয়োগ বিষয়ে কোনো নীতিমালা নেই বাংলাদেশের। বিশেষ বিবেচনায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৩ সালে মবিল-যমুনা লিমিটেড (এমজেএল) বিশেষ অনুমোদন নিয়ে প্রথম মিয়ানমারে বিনিয়োগ করে। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে বিনিয়োগ করেছে। এখন পর্যন্ত বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ চার কোটি এক লাখ ডলার বা ৩৭৩ কোটি টাকা (১ ডলার ৯৩ টাকা ধরে)।

এদিকে জাতিসংঘ বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২২’-এর তথ্যমতে, ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে (এফডিআই স্টক আউটওয়ার্ড) ৩৯ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় তিন হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের অবৈধ বিনিয়োগ তিন হাজার ২৫৪ কোটি টাকা।

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি জানেন না। তারা এ প্রসঙ্গে জানান, ‘বিদেশে বিনিয়োগ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হয়। যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই শেষে অনুমতি দিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পর্যন্ত বেশ কিছু কোম্পানি অনুমতি নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। আবার অনেকে অনুমোদন নিলেও বিনিয়োগ করেনি। শুধু সে হিসাবই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রয়েছে। এর বাইরে কোনো বিনিয়োগ রয়েছে কি না বা তার পরিমাণ কত তা জানা নেই।’

যদিও বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগের অস্বাভাবিক পরিমাণকে সিরিয়াস ম্যাটার বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিদেশে বিনিয়োগের জন্য লিখিত অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বৈধ বিনিয়োগের ৯ গুণ অবৈধ বিনিয়োগ অবশ্যই অস্বাভাবিক। তাই বিনিয়োগের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত। আঙ্কটাডের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনিয়োগের সোর্সগুলো দেখা দরকারÑএটি কীভাবে গেল। মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে রপ্তানি আয়ের একটি অংশ নাকি আমদানি দায় বেশি দেখিয়ে সেই অর্থ গেছে, কোন দেশে বিনিয়োগ করা হয়েছেÑএসবও বের করা দরকার। পাশাপাশি কারা এ অর্থ পাঠাল, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ যৌথভাবে এটি দেখতে পারে। এটি দেখা না হলে ভবিষ্যতে এই প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২১ জুন পর্যন্ত ৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে এমজেএল বাংলাদেশ লিমিটেড মিয়ানমারে চার লাখ ৪০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরেও এক লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিটি। এছাড়া এস্তোনিয়ায় দুই হাজার ৫০০ ইউরো বিনিয়োগ করেছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। একই দেশে ডিবিএল গ্রুপের বিনিয়োগ ৯৫ লাখ ডলার। আর কেনিয়ায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বিনিয়োগ এক কোটি ডলার।

সিঙ্গাপুরে স্পেক্ট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম (প্রা.) লিমিটেড ১০ হাজার ৫০০ সিঙ্গাপুর ডলার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এএসএম মহিউদ্দিন মোনেম সাত হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার, মালয়েশিয়ায় আকিজ জুট মিলস লিমিটেড দুই কোটি ডলার, কেনিয়ায় বিএসআরএম ২৭ হাজার ২০০ ডলার ও আয়ারল্যান্ডে রেনাটা লিমিটেড সাত হাজার ১০০ ইউরো বিনিয়োগ করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশিদের বৈধ বিদেশি বিনিয়োগ চার কোটি এক লাখ ২৯ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার, ৯ হাজার ৬০০ ইউরো ও ১০ হাজার ৫০০ সিঙ্গাপুর ডলার। সব মিলিয়ে এর পরিমাণ প্রায় চার কোটি এক লাখ ৪৭ হাজার মার্কিন ডলার।

এদিকে আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বিদেশে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রবণতার বিষয়টি এরই মধ্যে উঠে এসেছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২২’-এর তথ্যমতে, ২০০০ সাল শেষে বাংলাদেশের এফডিআই স্টক আউটওয়ার্ড ছিল ছয় কোটি ৮০ লাখ ডলার। ২০১০ সাল শেষে তা সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। অর্থাৎ ১০ বছরে বাড়ে মাত্র তিন কোটি ডলার।

যদিও পরের ১০ বছরে তা দ্রুত বেড়েছে। ২০২০ সাল শেষে বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ ১০ বছরে (২০১০-২০২০) বাংলাদেশিদের বিদেশে বিনিয়োগ বেড়েছে ২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় ২৩৪ শতাংশ। আর গত বছর তা বেড়েছে ছয় কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়েছেÑতা বিভিন্ন বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট, সিঙ্গাপুরে দেশীয় বিভিন্ন কোম্পানির অফিস স্থাপন ও বিনিয়োগের তথ্য উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। এছাড়া অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম আইসিআইজের প্রকাশিত পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস, অফশোর লিক, সুইস লিক ইত্যাদিতেও বাংলাদেশিদের বিভিন্ন দেশে অবৈধ বিনিয়োগের তথ্য উঠে এসেছে। এ নিয়ে বিএফআইইউ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাৎক্ষণিক সরব হলেও পরে তা আর এগোয়নি। এর ফলে বিভিন্ন কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, যা উদ্বেগের বিষয়।