বানভাসিদের দুঃখ-দুর্দশা

সাধন সরকার: সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিন কাটছে উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বানভাসি মানুষের। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এখন পর্যন্ত  প্রায় ৯০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি বলছে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যে বন্যাদুর্গতরা অনেক কষ্ট করে দিনাতিপাত করছেন! বানভাসি মানুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠাঁই নিয়েছে। বন্যার পানি কমে আসতে শুরু করলেও দ্বিতীয় দফায় নদনদীর পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বানভাসিদের কষ্ট খুব তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে না! বন্যাদুর্গত এলাকায় রাস্তাঘাট বেহাল। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সড়কপথ মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি বন্যায় হারিয়ে গেছে। গবাদিপশু বন্যায় ভেসে গেছে। ফসলক্ষেত তলিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সিলেট-সুনামগঞ্জ! স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখলে মনে হবে পুরো সিলেট পানিতে ভাসছে। একথা ঠিক যে, বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নিন্ম আয়ের মানুষেরা। তবে সিলেট বিভাগের এই ভয়াবহ বন্যা ধনী-গরিব সব স্তরের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানির জন্য চারদিকে হাহাকার চলছে।

এখন সবচেয়ে জরুরি হলো বিধ্বস্ত জনপদে বন্যাদুর্গতের পাশে দাঁড়ানো। বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, জরুরি ওষুধ ও শুকনো খাবারের জন্য হাহাকার বাড়ছে। বন্যা চলাকালে সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াও বন্যা-পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। ঘরবাড়ি নির্মাণ-মেরামত এবং কৃষকদের চাষ ব্যবস্থায় সাহায্য-সহযোগিতা দরকার। ভয়াবহ এই বন্যায় মানুষের পাশে আশপাশের মানুষই সবার আগে এগিয়ে এসেছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির উদ্যোগে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। তবুও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এক্ষেত্রে বিত্তবানদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। সার্বিক

বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশে খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ভাটির দেশ হিসেবে স্বাধীনতার আগে-পরে এবং বর্তমান সময়ে বন্যা একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষা মৌসুমে এদেশে প্রতিবছর কম-বেশি বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদ-নদী ভারতের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ৫৪টি নদ-নদীর সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের সংযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের চারপাশে অবস্থিত ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গের মাত্রাতিরিক্ত পাহাড়ি ঢল আন্তঃসীমান্ত নদী তথা বাংলাদেশের নদ-নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে চলে যায়। এটা একটা চরম বাস্তবতা যে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত থেকে পানি আসে না, আবার বর্ষা মৌসুমে যখন পানি লাগবে না, ঠিক তখনই পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার সম্পর্ক বিদ্যমান। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যা, নদীভাঙন, খরা ও ঘূর্ণিঝড় বাড়বে বৈ কমবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকা সামান্যই। বৃষ্টি-বন্যা আগেও ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। নদ-নদীগুলো যদি ভরাট না হয়ে যেত, জলাভূমি ও খালবিল দখল না হয়ে যেত, তাহলে বন্যা মাত্রা ছাড়িয়ে যেত না। সুরমা-কুশিয়ারা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার মাশুল দিচ্ছে সিলেট। পুকুর, খাল-বিল ও জলাভূমি ভরাটের মাশুল দিচ্ছে ‘৩৬০ আউলিয়ার দেশ’। শুধু সিলেটের নদ-নদী নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদী দখল ও ভরাট হয়ে গেলেও তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আবার নদী খননের অর্থ পরিকল্পিতভাবে খরচ না করে নয়-ছয় করার বহু উদাহরণ আছে চারপাশে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাহাড়ি ঢল ও  বর্ষার সময় বন্যার পানি নদ-নদী দিয়ে নেমে যাওয়ারও পথ থাকে না। কেননা  বেশিরভাগ নদ-নদীর সঙ্গে শাখানদী ও উপনদীর সংযোগ কাটা পড়েছে। প্রতিবছর বর্ষার সময় ভারতের আসা পাহাড়ি ঢল আর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে কেন বাংলার মানুষ মারা যাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে? অমোঘ নিয়তি বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার বৈজ্ঞানিক উপায় খুঁজতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদী বাঁচিয়ে বাংলাদেশকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। যেকোনো মহাদুর্যোগ মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার পথ খুঁজে বের করতে না পারলে কোনো উন্নয়ন টেকসই হবে না। আসুন, যার যার অবস্থান থেকে আপাতত বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াই।    

শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী