হাসান সেনজিক: উপহার দেয়া-নেয়া নিশ্চয় একটি উৎকৃষ্ট প্রথা। উপহার আদান-প্রদানে নিজেদের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়। পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এটা সামাজিকতা রক্ষার অনন্য উদাহরণও বটে। রমজান মাসে বাংলাদেশে প্রচলিত একটি রেওয়াজ হলো মেয়ের বাড়ি থেকে তার শ্বশুরবাড়িতে ইফতার ও ঈদ উপহার পাঠানো। এটি বাংলাদেশে রমজান মাসের একটি সামাজিক উপাদান হয়ে গেছে। হাদিয়া বা উপহার দেয়া-নেয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে রমজান মাসে শ্বশুরবাড়ি থেকে ইফতার এবং ঈদ উপহার পাওয়া ছেলেপক্ষের জন্য সাধারণ সামাজিক ব্যাপার হয়ে গেছে। কিন্তু অনেকের জন্য এই সামাজিকতা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয়তো দেশের বেশিরভাগ পরিবারের ইফতার এবং ঈদ উপহার দেয়ার আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, কিন্তু এমন অসংখ্য পরিবার আছে যাদের আর্থিক সক্ষমতা নেই। তবুও শুধুই সামাজিক দায়বদ্ধতা বা লোকলজ্জার ভয়ে ইফতার বা ঈদ উপহার দিয়ে থাকেন। এসব পরিবারের ঈদ উপহার পাঠানো তাদের জন্য জুলুম হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে মেয়ের বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে ইফতার এবং ঈদ উপহার পাঠানো শ্বশুরবাড়িতে থাকা মেয়ে বা বোনদের জন্য প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া ইফতার ও ঈদ উপহার না পাঠালে অনেক পরিবার খোঁটা দিতে থাকে। কথায় কথায় ঘরের বউকে নানা কটু কথা শোনায়। কাজেকর্মে শ্বশুরবাড়ির লোকজন এ কারণে নানা কষ্ট দেন। এতে বাধ্য হয়েও অনেক মেয়ে তার বাপের বাড়িতে ইফতার বা ঈদ উপহারের দাবি জানায়।
অনেক পরিবার এমনও আছে, ঘরের বউকে বাধ্য করে বাপের বাড়ি থেকে ঈদ উপহার নেয়ার জন্য স্বয়ং স্বামী বাড়ির লোকজন শ্বশুরবাড়ি থেকে ঈদ উপহার চেয়ে বসে। বিয়ের সময় কনের পরিবারের সামর্থ্য-সক্ষমতা দেখে বিয়ে করলেও বরপক্ষ ঘরের বউকে বাপের বাড়ি থেকে উপহার আনতে বাধ্য করে। কনের বাড়ি থেকে ইফতার না পেয়ে স্ত্রীকে মারধর করা, বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া, তালাক দেয়া এমনকি কনেকে হত্যা করার মতো ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। কনের পরিবার থেকে বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে উপহার দাবি করার মতো ভিক্ষাবৃত্তি সমাজে সামাজিকতার নামে বহুল প্রচলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক পরিবার তার বোন বা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানা কটু কথা, খোঁটা না শোনার জন্য নিজেরা দুবেলা খেতে না পেলেও ধারকর্জ করে গাড়িভর্তি ইফতার বা ঈদ উপহার পাঠান।
আবার ‘নি¤œবিত্তের ঘোড়ারোগ’-এর মতো সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও আছে বলে দেখাতে হবেÑএমন লোক দেখানো মানসিকতা এসব জঘন্য রীতি-রেওয়াজ বিস্তারের অন্যতম কারণ। এদের জন্য অনেক সামর্থ্যহীন পরিবার চাপে পড়ে উপহার পাঠাতে বাধ্য হয়। কোরবানির ঈদে মেয়ে বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে গরু-ছাগল পাঠানো এ ধরনেরই আরেকটি নিকৃষ্ট প্রথা। এতে করে অনেক নি¤œবিত্ত পরিবার নিজেদের সম্মান ধরে রাখতে, শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের অবস্থান বজায় রাখতে নিরুপায় হয়ে ছাগল পাঠাতে বাধ্য হয়। অথচ সামর্থ্য থাকলেই কেবল কোরবানি করতে বলা হয়েছে। শুধু দুই ঈদ নয়, বিয়ে, জš§দিনসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে উপহার এখন আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার ছাড়া উপস্থিত হলে লোকজন এমনভাবে তাকায় যেন কোনো চিড়িয়া দেখছে। অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্টের প্রিপেইড সিস্টেমের মতো এসব সামাজিক দাওয়াতে খাওয়ার আগেই উপহার বুঝে নেয়া হয়। এজন্য দরিদ্ররা উপহার আনতে বাধ্য হন। এটা তো অক্ষমদের ওপর জুলুম বৈ আর কিছু নয়। অথচ এই উপহারের আর্থিক মূল্য হিসাব করে রীতিমতো সম্পর্কের গভীরতা মাপা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মৌসুমে আম-কাঁঠাল পাঠানো অনেক অঞ্চলে বাধ্যতামূলক ভাবা হয়। সন্তানের আকিকা পালন করতে মেয়ে বাড়ি থেকে ছাগল পাঠানো এ ধরনেরই আরেকটা প্রথা। যাদের পাঠানোর সামর্থ্য আছে হয়তো তাদের কাছে এটা একটা রেওয়াজ ছাড়া কিছুই না। কিন্তু সামর্থ্যহীন বাবার কাছে এটা স্রেফ বোঝা। লোকলজ্জার ভয়ে মেয়ের বাবা সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ছাগল পাঠাতে বাধ্য হয়। অনলাইনে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব গলাকাঁটা জঘন্য রেওয়াজ, রীতি-নীতির বিরুদ্ধে নানা কথা বলা হলেও বাস্তবক্ষেত্রে তা ভিন্ন। সমাজে আত্মসম্মান ধরে রাখতে কিংবা শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে বা বোনের কষ্টহীন সুষ্ঠু জীবনযাপন নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন অজুহাতে, নানা কারণে এসব নিকৃষ্ট প্রথা সমাজে এখনও বিদ্যমান। যদি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা না যায়, যদি ব্যক্তি পর্যায়ে আমরা সামাজিকতার নামে এসব জঘন্য প্রথার বিরোধিতা না করি, যদি এ ধরনের রেওয়াজগুলো বর্জন না করি তাহলে তা কখনোই বন্ধ হবে না।
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়