আত্মহত্যার কারণ ও উত্তরণের উপায়

ইমরান উদ্দিন: আত্মহত্যা বর্তমান সমাজে অত্যন্ত জটিল একটি দৃশ্যমান বিষয়। বেঁচে থাকার আনন্দকে অস্বীকার করে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধ, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত হতাশা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মানসিক পীড়ন থেকে উত্তরণের মাধ্যম হিসেবে আত্মহত্যা নামক এই আত্মবিধ্বংসী পথকে বেছে নিচ্ছে তরুণসমাজ। বর্তমানে এই আত্মঘাতী সামাজিক ব্যাধি তরুণসমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আবার অনেকে এমনও আছে যারা একে অপরের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে এই চিরায়ত অভিশপ্ত পথে যাত্রা করে। বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, আত্মহত্যার কারণ হিসেবে রয়েছেÑসম্পর্কের অবনতি ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যা-১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, পড়াশোনা-সংক্রান্ত ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং আর্থিক সমস্যা ৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, সারাবিশ্বে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে ৭৫ শতাংশ বা তিন-চতুর্থাংশই নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ হতাশা। বাংলাদেশের ১৮ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো হতাশায় ভুগছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এই হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অথচ আমরা এমন এক সুশীল সমাজে পৌঁছে গেছি যে, এটা একটা রোগ, সেটাই অনেকে জানে না; চিকিৎসা প্রদান তো বহুদূর। গত বছর বাংলাদেশে ১০১ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে এ তথ্য জানা গেছে।

আত্মঘাতী সামাজিক ব্যাধির করাল গ্রাসে ভেসে যাচ্ছে তরুণসমাজ। আত্মহত্যার এই বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে অসচেতন অভিভাবকের দায়ভার একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের সুশিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা, বন্ধুসুলভ আচরণ এবং সৃজনশীল কাজে পরামর্শ ও সহযোগিতা করা। উপরন্তু বিনোদনের সব ধরনের ব্যবস্থা করা, যাতে বিচ্ছিন্নতাবোধের কালো ছায়া না পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে আট লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে।

ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, আর্থিক সংকট, সম্পর্কের অবনতি, মানসিক যন্ত্রণা এবং পড়াশোনা-সংক্রান্ত সমস্যাগুলোই এর প্রধান কারণ। এই সমস্যাগুলো কোনোটাই স্থায়ী নয়। একজন মানুষ যখন যদি নিজ ধর্মের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করে, ধর্মীয় রীতি মেনে চলে, তখন সে আত্মহত্যার মতো ব্যাধিতে ভুগতে পারে না। মুসলিম, খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধÑকোনো ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থে আত্মহত্যায় উৎসাহিত করা হয়নি; বরং আত্মহত্যা একটা মহাপাপ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্রষ্টা মানুষকে অন্যান্য সব সৃষ্টির চেয়ে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং সব সৃষ্টিকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। আর স্রষ্টা মানুষকে স্বতন্ত্রভাবে তার কাজের জন্য জীবনদান করেছেন, তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় দিয়েছেন। তার হায়াত শেষ হলে সে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। কিন্তু সেটার অপেক্ষা না করে স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে নিজেই যখন আত্মহনন করে, তখন স্রষ্টা তার ওপর রাগান্বিত হন এবং তাকে নরক তথা জাহান্নামের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেন। তার জন্য দুনিয়া-আখিরাত উভয়ই ধ্বংসক্ষেত্রে পরিণত হয়।

নারীঘটিত সমস্যার কারণে অনেকে আত্মহত্যা করে। মানুষকে স্রষ্টা জৈবিক চাহিদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। স্বাভাবিকভাবে মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে। স্রষ্টা সে চাহিদা মেটানোর জন্য হালাল উত্তম পন্থা ‘বিয়ে’ চালু করে দিয়েছেন, যেটা সামাজিকভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও বৈধ। মানুষ যখন বৈধ পন্থা বাদ দেয় এবং অবৈধভাবে একজন পুরুষ কারও অজান্তে নারীর প্রতি আসক্ত হয়ে যায়। তাকে ছাড়া অন্য কিছু ভেবে পায় না, অথবা একজন নারী একজন পুরুষের প্রতি আসক্ত হয়ে যায়।  পরে ওই নারীকে না পেয়ে পুরুষ এবং ওই পুরুষকে না পেয়ে নারী ডিপ্রেশনে চলে যায়। এই ডিপ্রেশন থেকে আত্মহত্যার চিন্তা আসে। এই সমস্যার হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সবাই সচেতনভাবে এগিয়ে এলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

পারিবারিক সমস্যা, পড়াশোনার সমস্যা, বেকারত্ব সমস্যা ও মানসিক পীড়ন থেকেও অনেকে আত্মহত্যা করে। এই সমস্যাগুলো অনেকটা ব্যক্তিগত। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের ধৈর্যধারণের বিকল্প নেই। সময় সবসময় একরকম যায় না। জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুসিবত আসবে। সেগুলো থেকে বের হওয়ার জন্য দরকার মানসিক শক্তি। সমস্যায় পড়ে যদি হতাশায় নিমজ্জিত হই, তাহলে আত্মহত্যার মতো ঘটনা আমাদের ওপর চেপে বসবে। যদি আমরা হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে দৃঢ়ভাবে সমাধানের পথ খুঁজি, সমাধানের চেষ্টা করি এবং বাকিটা স্রষ্টার ওপর তাওয়াককুল রেখে চলি, তাহলে এটা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে বলে মনে করি।

সাম্প্রতিক সময়ে এপ্রিল মাসে সোহাগ খন্দকার (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়), অন্ত রায় (কুয়েট), পল্লবী মণ্ডল (বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়), ইমরান হোসেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), অমিত কুমার (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), সাদিয়া তাবাসসুম, চতুর্থ বর্ষ (রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়), জায়না হাবিব প্রাপ্তি, দ্বিতীয় বর্ষ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)Ñএ কজনের আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সম্পর্কের অবনতি, বেকারত্ব সমস্যা, মানসিক পীড়ন, আর্থিক সংকট প্রভৃতি সমস্যাই তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান। আমরা যদি আমাদের চারপাশে নজর দিই, তখন এরকম মানসিক পীড়নগ্রস্ত ও অনেক মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ পাওয়া যাবে। বিশেষ করে বর্তমানে এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আত্মহত্যার অনেক আগে থেকেই নিজের অবস্থা স্পষ্ট করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেয়া হয়। তাই বন্ধুমহলের উচিত এই স্ট্যাটাসগুলো দেখে তাকে মানসিকভাবে সাহস জোগানো, ডিপ্রেশন কমানোর চেষ্টা করা, সময়-সুযোগ করে ঘুরতে যাওয়া, প্রয়োজনে মানসিক ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া এবং পরিবারকে অবহিত করা। আমি মনে করি, আত্মহত্যা নয় আত্মগঠনই হোক লক্ষ্য। প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতা-সংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপর্যুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এই ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর। উন্নত বিশ্বে চরম মুহূর্তের জন্য হটলাইন রয়েছে, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাদের চিন্তা-ভাবনা ও আত্মহত্যার পরিকল্পনার কথা জানায়। হটলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে ভুক্তভোগী তার সমস্যার সমাধান সম্পর্কে অবহিত হয়ে আত্মহত্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিজেকে ভালোবাসাই আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায়।

শিক্ষার্থী

আরবি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়