শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: গত ৩ জুলাই গাজীপুরের কাশিমপুরে মাল্টিফ্যাবস গার্মেন্টে ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণ ঘটে। ওই বিস্ফোরণে ১৩ শ্রমিক নিহত হন। এ সম্পর্কিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৪ জুলাইয়ের সংবাদগুলো থেকে জানা যায়, তখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিখোঁজ ছিলেন। মাল্টিফ্যাবস গার্মেন্টে যে বয়লারটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। আর এ কারণেই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানিয়েছে এতদসম্পর্কিত গঠিত তদন্ত কমিটি। শিল্পকারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ এখন যেন একটা নিয়মেই পরিণত হয়েছে! এতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ শ্রমিক। এর কোনো প্রতিকার নেই। মেয়াদোত্তীর্ণ বয়লার ব্যবহার করে শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটানোটা শ্রমজীবী মানুষ হত্যার সমতুল্য। এ ধরনের ত্রুটিযুক্ত বয়লার বা মেশিনারিজ ব্যবহার করে যারা মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, তাদের কেন বিচার হয় না। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি দেশের শ্রমজীবীরা, তাদের অনিরাপদ স্থানে কাজ করতে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে; তাই এ মৃত্যুর দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপরই বর্তায়। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল দিনাজপুরের যমুনা অটো রাইস মিলে বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হন ১৮ শ্রমিক। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীতে সিগারেটের ফয়েল তৈরির কারখানা ট্যাম্পাকোয় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৫০ শ্রমিক মারা যান। ওইদিন বয়লার বিস্ফোরণে শ্রমিকদের সঙ্গে কারখানার পাশের রাস্তায় পথচারীও নিহত হন। সে দুর্ঘটনার কারণও বয়লার বিস্ফোরণ। ওই সময় আহত হয়েছিলেন শতাধিক শ্রমিক। তাদের মধ্য থেকে পরে বেশ কয়েকজন মারা যান। বিস্ফোরণের ফলে কারখানা ভবনটি ধসে পড়েছিল। ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর গাজীপুরের শ্রীপুরে পলমল শিল্প গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা আসওয়াদ কম্পোজিটে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। এতেও জীবন ক্ষয়ের ঘটনা ঘটে। ওই দুর্ঘটনার কারণও বয়লার বিস্ফোরণ। বাংলাদেশে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে কাজ করেন। কারখানাগুলো কেন নিরাপদ হচ্ছে না শ্রমিকের জন্য? গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১১২৯ শ্রমিক; আহত হন দুই হাজার ৫০০’র বেশি আর নিখোঁজ ছিলেন ৯৯৬ জন। সাভারের আশুলিয়ায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। ওই ঘটনায় ১২৪ পোশাকশিল্প শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন অর্ধশতাধিক আর আহত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন প্রায় ২০০’র মতো। ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার মিরপুরে সারাকা গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা যান ৩০ শ্রমিক। ১৯৯০ সালের আগস্টে গ্লোব নিটিংয়ে আগুনে পুড়ে মারা যান ১২ শ্রমিক। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যারে মারা যান ৫০ শ্রমিক। ২০০১ সালের ৮ আগস্ট মিকো সোয়েটারে আগুন লাগার পর পদদলিত হয়ে মারা যান ২৪ শ্রমিক। ওই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২৫ শ্রমিক। ২০০৪ সালের ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেটে আগুন লেগে মারা যান ৯ জন। ২০০০ সালে নরসিংদীর শিবপুরে এক গার্মেন্টে আগুনে মারা যান ৪৮ শ্রমিক। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের এক পোশাক কারখানায় আগুনে মারা যান ২২ শ্রমিক। ২০০৬ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৯১ শ্রমিক। ২০০৬ সালে গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে আগুনে মারা যান ছয় শ্রমিক। ২০০৬ সালের মার্চে সায়েম ফ্যাশনে মারা যান তিন শ্রমিক। ২০১০ সালে গাজীপুরের গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে আগুনে মারা যান ২১ জন। ২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামিম গ্রুপে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৩০ শ্রমিক। আগুনে পুড়ে ও ভবন ধসে গত দুই দশকে প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হয়েছেন হাজার হাজার আর পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে হাজারখানেক কর্মজীবীকে। গাজীপুরে এক বছরে বয়লার বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০ শ্রমিক। বয়লার পরিদর্শনের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা কীভাবে এ দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন! এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা কিন্তু গণমাধ্যমে আসে না। দেশে শ্রমজীবীদের নিয়ে কথা বলার লোক নেই। রাজনীতিকরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থে শ্রমিকদের ব্যবহার করছেন। ঈদের দুই দিন আগে রংপুর মহাসড়কে সিমেন্ট বোঝাই ট্রাক উল্টে মারা যান ১৭ পোশাকশিল্প শ্রমিক। নিহতরা গাজীপুর থেকে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছিলেন। এদের প্রায় সবার বাড়িই লালমনিরহাটে। অনেকেই দুর্ঘটনার পর এ দায় শ্রমিকদের ওপর চাপিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছেÑকেন তারা সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকে উঠলেন। মালভর্তি ট্রাকে ভ্রমণ করা অবশ্যই অপরাধ। সরকার ঈদের তিন দিন আগে মহাসড়কে মালামাল পরিবহন করা যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছে; তারপরও কী করে ঈদের দুদিন আগে গাজীপুর থেকে সিমেন্টভর্তি ট্রাক যাত্রী পরিবহন করলো! বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই। একজন পোশাকশিল্প শ্রমিককের বেতন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা। ঈদ উপলক্ষে ঢাকা-রংপুরের বাসভাড়া ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করা হয়। তাই শ্রমিকদের স্বল্প ভাড়ার পরিবহনে ওঠাটাই স্বাভাবিক। দেশের অধিকাংশ পোশাকশিল্প শ্রমিক উত্তরবঙ্গের। পোশাকশিল্প মালিকরা তাদের বাড়ি পাঠানোর বিশেষ ব্যবস্থা দিতে পারে। শিল্প এলাকায় যেসব স্থানে শ্রমিকরা থাকেন, তাদের কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার জন্য বিশেষ বাস রয়েছে। ঈদের ছুটির সময় ওই বাসগুলো শ্রমিকদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দিতে পারে। তাহলে এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নাও ঘটতে পারে।
শিল্পে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় যে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়, তা নিয়েও চলে নানা কারসাজি। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার পরিবারকে কিছু অর্থ সহায়তা দিলেই কী সব মিটে যায়? শ্রমিকের কর্মস্থল কতটা শ্রমবান্ধবÑসে বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই। কারণ দেশের শিল্পকারখানাগুলোয় শ্রমিক পেতে অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশের ৬০ ভাগ মানুষের জীবন-জীবিকা কোনো না কোনোভাবে কৃষি খাতে নির্ভরশীল। দেশের মোট কর্মক্ষম জনসম্পদের ৪৭.৫ শতাংশ শ্রমশক্তি সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। দেশের কৃষির মালিকানা চলে যাচ্ছে বড় পুঁজিপতিদের হাতে। বাংলাদেশের গ্রামগুলোয় পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলছেন কৃষিখামার। এ টাকাওয়ালারা প্রান্তিক চাষিদের জমি কিনে নেন বা বাৎসরিক ভাড়া হিসেবে খামারভুক্ত করেন। আর এ কারণে প্রান্তিক চাষিরা হয়ে যাচ্ছেন বেকার। এই গড়ে ওঠা কৃষিখামারগুলোয় আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হয়। ফলে শ্রমিকের প্রয়োজন হয় অনেক কম। আধুনিক প্রযুক্তি ও কৃষিকাজে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে প্রতি বছরই কৃষি খাত থেকে শ্রমসম্পদ উদ্বৃত্ত হচ্ছে। এ উদ্বৃত্ত শ্রমসম্পদ শিল্প অভিমুখী হয়ে যায়। এজন্য দেখা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহের ভালুকার দিকে ছুটছে। এ কারণে দেশের কারখানা মালিকরা সহজেই শ্রমিক পেয়ে যান। তাই দেখা যায়, মালিকের কাছে শ্রমিকের শ্রমের গুরুত্বই বেশি, শ্রমিকের নয়। কারণ একজন শ্রমিক কোনো কারণে মারা গেলে তাতে কারখানায় শ্রমিকশূন্যতা সৃষ্টি হয় না। মালিকরা জানেন, অগণিত শ্রমিক কাজের আশায় তাদের শিল্পকারখানার আশেপাশে ঘুরছেন। দেশের বিরাট জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন শিল্পমালিকরা। তাই শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা তাদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হলো মুনাফা। সারা দেশে শ্রমিক মৃত্যুর চিত্রটা দেখলে মনে হয় শিল্পমালিকরা অন্যান্য কাঁচা পণ্যের মতো শ্রমসম্পদকে ব্যবহার করেন। তাই কর্মস্থলে শ্রমিকের মৃত্যু রোধে তাদের কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেই। দেশে ৯০ দশকের পর থেকে বেসরকারিভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে শুরু করে। সে সময় থেকেই ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা। সে হিসেবে প্রায় তিন দশক পার হলো; তারপরও শ্রমিক মৃত্যু রোধে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। দেশে শ্রমসম্পদের কল্যাণে আজ বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগুচ্ছে। তাই যাদের শ্রমের বিনিময়ে দেশের এই প্রাপ্তি, তাদের নিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব। দেশের মানুষ আর একজন শ্রমিকের মৃত্যুও দেখতে চায় না। আর যেন কোনো শ্রমিকের কারখানা দুর্ঘটনায় মৃত্যু না হয়, সংশ্লিষ্টরা সে ব্যবস্থা নেবেন এটাই সাধারণের প্রত্যাশা।
ফ্রিল্যান্স লেখক
shahzia84Ñyahoo.in