বাছাই করতে হবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ভোজ্যতেল

 

সৈয়দা নূরুন্নেসা বেগম: ভোজ্যতেল দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য খাদ্য উপাদান। রান্নাবান্না, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিয়েবাড়ি, বড় ফুড ইন্ডাস্ট্রি ও বেকারিতে ভোজ্যতেলের ব্যবহার অস্বীকার করার উপায় নেই। শরীরে দৈনন্দিন ক্যালরি চাহিদার ৩০-৩৫ শতাংশ তেলের মাধ্যমে পূরণ হওয়া প্রয়োজন এবং এর বেশিরভাগই হয় ভোজ্যতেল দিয়ে। বাকিটা সাধারণত মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম থেকে পূরণ হয়। তবে ভোজ্যতেল হওয়া উচিত ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত।

ভোজ্যতেল প্রস্তুত ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গণমাধ্যমে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে প্রায়ই বলে থাকে কোলেস্টেরলমুক্ত তেলের কথা। উদ্ভিজ্জ তেলকে কোলেস্টেরলমুক্ত করার সুযোগ নেই, কারণ তাতে এমনিতেই কোনো কোলেস্টেরল থাকে না। প্রাণিজ তেল মানুষের শরীরে কোলেস্টেরল তৈরিতে কাজ করলেও উদ্ভিজ্জ তেল তেমনটি করে না। সে কারণে বিশ্বজুড়ে রান্নাবান্নায় উদ্ভিজ্জ তেলের ব্যবহারই বেশি।

দেশে ষাটের দশক পর্যন্ত রান্নার কাজে সরিষার তেলের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। গ্রামাঞ্চলে এর ব্যবহার এখনও রয়েছে। রান্নার পাশাপাশি এ তেল গ্রামের মানুষ গায়ে মাখে ও চুলে ব্যবহার করে। অবশ্য রান্নার কাজে ধীরে ধীরে এর স্থান দখল করে নিয়েছে সয়াবিন তেল। অন্য তেলের মতো সরিষার তেলেও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী মনোস্যাচুরেটেড ও পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকলেও এতে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ প্রায় ৪৭ শতাংশ। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সরিষার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে বিক্রি নিষিদ্ধ। শুধু বাহ্যিক ব্যবহারের জন্য সেখানে এটি বাজারজাত করা হয় এবং মোড়কের ওপর তা মুদ্রিতও থাকে। অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড থাকায় এটি হƒৎপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া এ তেল শরীরের হাতে-পায়ে পানি আনতে পারে। ভর্তা ও ঝালমুড়ি মাখানোর ক্ষেত্রে এর ব্যবহার রয়েছে। ইদানীং তেহারি রান্নায়ও সরিষার তেলের ব্যবহার বেড়েছে। তবে ভোজ্যতেল হিসেবে এর ব্যবহার সীমিত রাখাই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

অন্যদিকে সয়াবিন বীজ থেকে উৎপাদিত সয়াবিন তেল শুধু দেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশে রান্নার কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। এতে রয়েছে ওমেগা-৬, ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৯ ফ্যাটি অ্যাসিড। এগুলোর উপস্থিতি রক্তে ‘মন্দ কোলস্টেরল’ কমাতে সহায়তা করে। বেক করার জন্য সয়াবিন তেলের চাহিদা দেশ-বিদেশে ক্রমে বেড়ে চলেছে।

সানফ্লাওয়ার অয়েল বা সূর্যমুখী তেলের ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে ওমেগা-৯ ও ৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো উপাদান ছাড়াও ভিটামিন ‘ই’-এর উপস্থিতি রয়েছে সন্তোষজনক পরিমাণে। ভিটামিন ‘ই’ শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে বিশেষভাবে কার্যকর, যা বার্ধক্যেকে ধীর করে দেয় ও ক্যানসার কোষের শত্রু হিসেবে কাজ করে।

রাইস ব্রান অয়েল বা ব্রান অয়েল হলো চালের কুঁড়ার নির্যাসিত তেল। বাংলাদেশ, চীন ও জাপানে এর চাহিদা ক্রমে বেড়ে চলেছে। উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিডের পাশাপাশি এতে রয়েছে অরিজানল ও টোকোফেরোল (ভিটামিন ‘ই’), যা নারীদের মেনোপজ-পরবর্তী ‘হটফ্ল্যাশ’ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এতে রয়েছে ফাইটোস্টেরনের আধিক্য, যা রক্তের মন্দ কোলেস্টেরলকে পরিপাকতন্ত্রে শোষণে বাধা দেয়। ফলে রক্তের মন্দ কোলেস্টেরল কমে আসে। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলেও এ তেলের দাম কিছুটা বেশি।

সে কারণে সর্বসাধারণের পক্ষে সব সময় এ তেল কিনে ব্যবহার সম্ভব নয়।

সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার ও রাইস ব্রানÑতিনটি ভোজ্যতেলেরই রয়েছে উচ্চ স্মোক পয়েন্ট। সাধারণত সয়াবিন, রাইস ব্রান ও সানফ্লাওয়ার অয়েল যথাক্রমে ২৫৭, ২৫০ ও ২২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পুড়ে ধোঁয়া উৎপন্ন করে। উচ্চ স্মোক পয়েন্ট হওয়ায় এসব তেল দিয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলেও এগুলোর গুণের বিশেষ ক্ষতি হয় না। শরীরের জন্য যেহেতু পোড়া তেল ক্ষতিকর আর এসব তেল যেহেতু উচ্চ তাপমাত্রায়ও সহজে পোড়ে না, তাই এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য সহজে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না।

পাম অয়েলও আজকাল দেশে ব্যবহার হচ্ছে। দাম কিছুটা কম হওয়ায় ছোটখাটো রেস্তোরাঁ এ তেল ব্যবহারে বেশি আগ্রহী। বেকারি খাদ্যপণ্যে বেশ ব্যবহার রয়েছে। মার্জারিন তৈরিতে এটি ব্যবহার হয়। ভিটামিন ‘এ’ তৈরি করার জন্য ক্যারোটিনয়েড থাকে। এছাড়া ভিটামিন ‘ই’ও এতে রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু অসম্পৃক্ত (আনস্যাচুরেটেড) ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রান্নায় এটি বেশি ব্যবহার না করাই ভালো। পাম অয়েল হƒদ্রোগের সমস্যা তৈরির পাশাপাশি রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

বিদেশে তো বটেই, বর্তমানে দেশেও অলিভ অয়েল বা জলপাই তেলের প্রচলন বাড়ছে। অতিরিক্ত মূল্যের জন্য অবশ্য এটি সাধারণের নাগালের বাইরে। এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলের পরিবর্তে ক্রুড বা অপরিশোধিত সূর্যমুখী বা সয়াবিন তেল সালাদ ড্রেসিং হিসেবে বেশ ভালো। অপরিশোধিত ভেষজ তেলের গুণ বেশি থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তা রান্নার উপযোগী নয়। সেক্ষেত্রে শুধু সালাদ ড্রেসিং হিসেবে তা ব্যবহার করা সম্ভব। অন্যদিকে পরিশোধিত তেল বেশি স্থায়ী (স্টেবল) ও রান্নার উপযোগী। পরিশোধিত অবস্থায় থাকলে রান্নার সময় উচ্চতাপে রাসায়নিক পর্যায়ে এর পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা থাকে কম। তিলের তেল বা সিসম অয়েল গ্রামবাংলায় আগে ব্যবহার হতো। বর্তমানে বেকারিতে বিশেষ কিছু খাবার তৈরিতে এ তেল ব্যবহার করা হয়। প্রাণিজ তেল যেমন ঘি, চর্বি প্রভৃতি থেকে উদ্ভিজ্জ তেল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তবে স্বাদ বাড়ানোর জন্য অসম্পৃক্ত (আনস্যাচুরেটেড) উদ্ভিজ্জ তেলকে হাইড্রোজেনেশনের মাধ্যমে সম্পৃক্ত (স্যাচুরেটেড) করে ফেলা হয়। পাউরুটি মাখিয়ে খাওয়ার মার্জারিন বা পরোটা ভাজা ও বেকারিতে ব্যবহার্য ডালডা বা বনস্পতি ঘি সম্পৃক্ত তেলের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সম্পৃক্ত তেল স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই ভালো নয়। এটি শরীরের কোলেস্টেরল বাড়াতে ভূমিকা রাখে। এ তেল এড়িয়ে চলা ভালো। তবে প্রাণিজ তেলের ক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছের তেল ব্যতিক্রম। এতে রয়েছে উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিডের আধিক্য। এজন্য সামুদ্রিক মাছের ব্যবহার আমিষের ঘাটতি পূরণের সঙ্গে শরীরে তেলের চাহিদা মেটাতেও সাহায্য করবে। তবে তেলের গুণের কথা যতই বলা হোক না কেন, তা গ্রহণ করতে হবে পরিমাণমতো। কারণ তেলে রয়েছে যথেষ্ট ক্যালরি, যা শর্করা ও আমিষের দ্বিগুণেরও বেশি। তেলের আধিক্যে অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় ভোগা কারও কাম্য নয়।

পরিশোধন করার সময় যাতে তেলের গুণ নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ভোজ্যতেলের গুণাগুণ অক্ষুণœ রাখার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সেক্ষেত্রে যেসব বোতল, কনটেইনার বা জারে এগুলো বাজারজাত ও সংরক্ষণ করা হয়, সেগুলো অতিবেগুনি রশ্মির জন্য অভেদ্য হওয়া প্রয়োজন।

ভোজ্যতেল হতে হবে ভেজালমুক্ত। বাজারে অস্বাস্থ্যকর ভোজ্যতেল বা ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে কি না কিংবা রেস্তোরাঁগুলোয় খাবারের স্বাদবর্ধনের জন্য স্বাস্থ্যকর তেলের সঙ্গে অতিরিক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, এমন তেল মিশিয়ে রান্না করা হচ্ছে কি না, তার নিয়মিত তদারকি জরুরি। অন্যথায় জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তবে কে কোন ধরনের ও কী পরিমাণে ভোজ্যতেল গ্রহণ করতে পারবে, তা সাধারণত নির্ভর করে বয়স, ওজন, উচ্চতা, খাদ্যাভ্যাস, পেশা এবং তার কী ধরনের অসুখ রয়েছেÑএসবের ওপর। কে কোন তেল ব্যবহার করবে, সেটি তার আর্থিক অবস্থার ওপরও অনেকটা নির্ভর করে। অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত কিছু তেল রয়েছে, যা অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সর্বোপরি স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে উপযুক্ত ভোজ্যতেল বাছাইয়ে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে।

 

অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন বিভাগ

ইউএস-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ