রাজশাহীতে পানের দাম না পাওয়ায় হতাশ চাষিরা

মেহেদী হাসান, রাজশাহী: হঠাৎ পানের দরপতনে দিশেহারা রাজশাহীর চাষিরা। বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে কয়েকগুণ লোকসানে চাষিদের পান বিক্রি করতে হয়েছে। তবে গত বছরের শেষ সময়ের দিকে পানের দাম বাড়তে শুরু করলে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয় তারা। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই ফের কমতে শুরু করেছে পানের দাম। বর্তমানের বাজারে পানের সর্বনি¤œ পোয়া (৩২ বিড়ায় ১ পোয়া) ২০০ টাকা! এতে চাষিদের মাথায় হাত পড়েছে।

চাষিরা বলছেন, কভিডের কারণে কয়েকগুণ কম দামে পান বিক্রি করতে হয়েছে গত দুই বছর। দফায় দফায় বন্যায় পান বরজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বর্তমান পানের বরজে রোগের প্রাদুর্ভাব তেমন দেখা নেই। কিন্তু দামও নেই। দেশের বাইরে পান রপ্তানি শুরু হতে সময় লাগবে। গতবার একই সময়ে বড় পানের বিড়া এখন ৭০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন তা ৩০ থেকে ৪০ টাকা বিড়া। আর ছোট পান ৭ থেকে ১০ টাকা বিড়া হিসেবে পোয়া বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে। বুধবার রাজশাহীর মোহনপুর এলাকার পানচাষি ও একদিলতলা হাটের পাইকারি ক্রেতা-ব্রিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে

চাষিরা জানান, বর্তমানে পুরোনো পান নেই হাটে, যা আছে সব নতুন গাছের নতুন পান। এসব পানের দাম আশানুরূপ পাচ্ছেন না। নতুনভাবে পানের বরজ তৈরিতে খরচ হয়েছে অনেক বেশি। বাঁশ, লোহার তার, কাঠের দাম বেড়েছে। ছাউনির খড়ের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে নতুন পানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন তারা। কিন্তু বড়, মাঝারি ও ছোট আকারের পানের দাম মানভেদে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর রাজশাহীতে চার হাজার ৩৬১ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে পান উৎপাদন হয়েছে ৭৩ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ১৬ দশমিক ৯১ মেট্রিক টন। গত বছর এক হাজার ১৭১ মেট্রিক টন পান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে।

রাজশাহীতে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি পান বেচাকেনা হয়। রাজশাহীর ৭২ হাজার ৭৬৪ জন কৃষক পান চাষের সঙ্গে জড়িত। জেলার মোহনপুর, দুর্গাপুর ও বাগমারা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পান চাষ হয়। এর মধ্যে বাগমারা উপজেলাতে উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। চলতি মৌসুমে বাগমারায় এক হাজার ৫৬০, দুর্গাপুরে এক হাজার ৪১০ এবং মোহনপুরে এক হাজার ১৮২ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছে।

মোহনপুর উপজেলার বাকশিমইল গ্রামের পানচাষি আশরাফ আলী বলেন, ১৫ কাঠা জমিতে পানের বরজ করেছি। শীত এলে পান গাছের গোড়ায় পচন ধরে, পাতা পেকে যায়, পাতা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে রোগের সমস্যা নেই, সমস্যা পানের দাম। যেই পানের পোয়া (৩২ বিড়ায় এক পোয়া) ৩ হাজার টাকা বিক্রি হওয়ার কথা সেই পান বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকা।

মোহনপুর সদরের পানচাষি হাসান আলী বলেন, ১০ কাঠা জমিতে পানের বরজ করেছি। পানের উৎপাদন কমে গেছে। আগে যেই পান বিক্রি হতো ৮০ থেকে ১০০ টাকা বিড়া। সেই পান এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকা। আগে বড় পান ৩২শ’ থেকে ৩৫শ’ টাকা পোয়া ছিল সেটা এখন ২২শ’। মাঝারি আকারের পান ১২শ’ থেকে ১৫শ’ টাকা। আর সবচেয়ে ছোট পান ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পোয়া বিক্রি হচ্ছে। অথচ ছোট পানই বিক্রি হতো ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা পোয়া।

পানের পাইকারি বিক্রেতা সাইদুর রহমান জানান, লকডাউনের সময় পানের বাজার খুবই কম ছিল। গত এক বছর পানের বাজার ওঠানামা করেছে। ছোট পানের পোয়া আগে ৮০০ টাকায় বিক্রি হতো, সেই পান এখন ২০০ টাকা। আবার বড় পানের পোয়া ৩০০০ টাকায় বিক্রি হতো, সেই পান এখন ১৮শ’ থেকে ২২শ’ টাকা।

দিলতলা পানের হাট কমিটির পরিচালক হারুন-অর-রশিদ জানান, পানের দাম কমেছে। নতুন পান বাজারে এসেছে। আর নতুন পানের দাম কম থাকে। পুরনো পান বাজারে নেই। সবচেয়ে ছোট পানের দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পোয়া বিক্রি হচ্ছে। বড় পান ২ হাজার। দাম বাড়ছে চাষিদের জন্য বেশ ভালো হবে।

রাজশাহী কৃষি তথ্য সার্ভিসের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ৯৩২ জন কৃষকের ৩৮ হাজার ৯০৬টি পান বরজ রয়েছে। এ বছর রাজশাহীতে চার হাজার ৩৬১ দশমিক ৪ হেক্টর জমিতে পান উৎপাদন হয়েছে ৭৩ হাজার ৭৭১ মেট্রিক টন। হেক্টর প্রতি ফলন প্রায় ১৬ দশমিক ৯১ মেট্রিক টন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, রাজশাহীর পান দেশের বাইরে রপ্তানি হওয়ায় কারণে চাষিরা বেশ লাভবান হন। বর্তমানে পানের দাম কিছুটা কম। শীতকালে পানের উৎপাদন কমে যায় সে সময় দামও বাড়ে। কিছু রোগের দেখা দেয় শীতকালে, এখন কোনো তেমন রোগের খবর আমাদের কাছে আসেনি। চাষিদের আরও সতর্ক হতে হবে। রোগবালাই বিষয়ে তিনি বলেন, ছত্রাকজনিত গোড়া পচা রোগ কিংবা পাতায় সমস্যা দেখা দিলে কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ছত্রাকনাশক হিসেবে ম্যানকোজেব এবং নন-সিস্টেমিক কীটনাশক কার্বান্ডাজিম কিংবা ব্যভিস্টিন ব্যবহার করলে ভালো ফল পেতে পারেন কৃষকরা।