শেয়ার বিজ: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মতামত কী?
তানভীর এ মিশুক: আমি মনে করি, ক্যাশ লেনদেনের এবং ম্যানুয়াল ব্যাংকিংয়ের দিন সারা পৃথিবীতেই শেষ হয়ে আসছে। আপনি আমাদের পাশের দেশগুলোতেও দেখবেন, ক্যাশ লেনদেন প্রায় নেই হয়ে যাচ্ছে। আমরাও এই জায়গাটায় অনেক এগিয়েছি। আমি মনে করি, আমরা খুব দ্রুত একটা ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে এগোচ্ছি। অন্তত লেস ক্যাশ সোসাইটি তো হতেই হবে। আর সেটা হতে পারে কেবল এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সামনে অমিত একটা সম্ভাবনা রয়েছে। বলতে পারেন, যে সম্ভাবনা আছে, আমরা এখনও তার ক্ষুদ্র একটা অংশ ধরতে পেরেছি মাত্র। বাজারের বেশিরভাগটাই এখনও আওতার বাইরে থেকে গেছে। তাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা অসাধারণ।
শেয়ার বিজ: এখন বাংলাদেশে ৬১টি ব্যাংক। তারপরও মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী?
তানভীর এ মিশুক: দেখুন, ট্রাডিশনাল ব্যাংক কখনও মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে না। আমাদের দেশে ব্যাংকিংয়ের এখনও যে ধারণা, সেটা খুব সেকেলে। এখনও মানুষকে ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়, লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়, গাদা গাদা কাগজ পূরণ করতে হয় একটা অ্যাকাউন্ট করতে। এটা মানুষের জীবনকে সহজ করার বদলে আরও জটিল ও সময়সাপেক্ষ করে তোলে। কিন্তু বিপরীতে এমএফএস এই সেবাটা মানুষের ড্রয়িংরুমে নিয়ে এসেছে। মোবাইল ব্যাংকিং করতে আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আপনি নিজের ফিচার ফোনটি দিয়েও সব প্রয়োজন মেটাতে পারবেন। পকেটে টাকা নিয়ে ঘোরার দিন আর নেই। ফলে এত ব্যাংক থাকার পরও মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং করছে।
শেয়ার বিজ: এমএফএস কি ব্যাংকের বিকল্প হতে পারে?
তানভীর এ মিশুক: এমএফএস ঠিক ব্যাংকের বিকল্প নয়। বলা যায় ডিজিটাল সহযোগী। আপনি তো ব্যাংকের লেনদেনও এমএফএসের মাধ্যমে করতে পারছেন। ফলে ব্যাংক ও এমএফএস পরস্পরের পরিপূরক। আপনি যদি সত্যিই ব্যাংকিংয়ের পরের ধাপটা, মানে ডিজিটাল রূপ দেখতে চান, তাহলে আপনি আজই ডিজিটাল ব্যাংকিং চালু করতে হবে। আমরা গত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কথা বলছি। আসলে কেবল এমএফএসের মাধ্য কিছু টাকা পাঠানো, গ্রহণ করা বা কিছু কেনাকাটা করে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি তৈরি হবে না। আপনাকে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ডিজিটাল করে ফেলতে হবে। আর জন্য দরকার ডিজিটাল ব্যাংকিং। এর কোনো বিকল্প নেই।
শেয়ার বিজ: মোবাইল ব্যাংকিং মার্কেটে মাত্র দুই থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য। এই সেবায় ব্যাংকগুলো অবস্থান নিয়ে আপনার মতামত কী?
তানভীর এ মিশুক: দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠান না বলে একটি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য বলা ভালো। মাঝে আমি সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশন একটি রিপোর্ট খসড়া করেছেন। সে রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে, একটি প্রতিষ্ঠান এজেন্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে বেশি কমিশন দিয়ে বাজারকে নন-কম্পিটিটিভ করে রেখেছে। এ ব্যাপারে আসলে বাকিদের কিছু করার নেই। আমরা বলতে পারি যে, এ জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং এই খাতটি বিকশিত হচ্ছে না। অনেকে এই খাতে ব্যবসা শুরু করেও গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য। এটা আসলে সরকারের ব্যাপার। সরকারকেই ঠিক করতে হবে যে, এই বাজারকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য কী করা যায়।
শেয়ার বিজ: মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের ঝুঁকি কতটুকু এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় গ্রাহক ও প্রতিষ্ঠানের করণীয় কী?
তানভীর এ মিশুক: প্রতিষ্ঠানের তরফে বা টেকনিক্যাল দিক থেকে কোনো ঝুঁকি নেই। আমি আমাদের কথা বলতে পারি। আমাদের সব কর্মকাণ্ড পুরোপুরি গ্রাহকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবে করা হয়। সেজন্য সর্বোচ্চ যা করা দরকার, তা-ই করি আমরা। কিন্তু তারপরও কিছু ঝুঁকি থেকে যায়। সমাজে কিছু অসাধু লোক থাকবেই, যারা যে কোনো পরিস্থিতির ফাঁক তৈরির চেষ্টা করবে। তবে গ্রাহক সচেতন হলে এই ফাঁকগুলোও বন্ধ হবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যে ঝুঁকিটা নিয়মিত দেখা যায়, সেটা মূলত গ্রাহকের গোপন তথ্য প্রকাশ করে দেয়ার মাধ্যমে ঘটে। কাউকে বিশ্বাস করে বা কারও কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজের পিন বা ওটিপি কাউকে দিয়ে দেয়া চলবে না। এগুলো একান্তই গ্রাহকের সম্পত্তি। এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোও কোনো গ্রাহকের কাছে এসব তথ্য চাইতে পারবে না। আমি মনে করি এসব ক্ষেত্রে আমাদের গ্রাহকদের আরও সচেতন করে তোলার একটা ব্যাপার রয়ে গেছে। একটা এমএফএস প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, আমরা সচেতন করার চেষ্টা করি। তবে রাষ্ট্রীয় কিছু উদ্যোগও থাকা উচিত।
শেয়ার বিজ: এমএফএস প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইন্টারঅপারেবিলিটি বা আন্তঃলেনদেনের বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?
তানভীর এ মিশুক: ব্যাংকের সঙ্গে এমএফএসের আন্তঃলেনদেন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমাদের সঙ্গেই এখন ২৭টি ব্যাংকের আন্তঃলেনদেন চালু আছে। এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এটা গ্রাহকের জন্য জরুরি। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার পর কেনাকাটা করতে যাবে। এটা হলে তো ব্যাপারটা ডিজিটাল হবে না। আবার কেউ ব্যাংকের টাকা বেশি করে এমএফএসে তুলেও রাখবে না। ফলে আন্তঃলেনদেন থাকলে গ্রাহক যখন-তখন ‘অ্যাড মানি’ করে এমএফএসে টাকা আনতে পারছেন, সেখান থেকে খরচ করতে পারছেন। এটা আসলে তিন পক্ষের জন্যই খুব ভালো একটা ব্যাপার।
শেয়ার বিজ: এই ব্যবসায় অনেক ব্যাংক লোকসান গুনছে, এমন কথা শোনা যায়। এর কারণ কী?
তানভীর এ মিশুক: লোকসান গোনার আসলে অনেক কারণ আছে। এটা আসলে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হবে। তবে সাধারণ কারণ হচ্ছে, বাজারে প্রতিযোগিতা নেই। আমি যদি গ্রাহকের কথা ভেবে চার্জ কম রাখি, তাহলে আমার লাভ হবে না এবং আমি গ্রাহক পাব না। কারণ গ্রাহক আমার কাছে আসবে কি না, সেটা ঠিক করে দিচ্ছে এজেন্ট। আর আমি চার্জ কম নিলে এজেন্টকে বেশি কমিশন দিতে পারব না। এখন যে বেশি কমিশন দিচ্ছে এবং যে বেশি চার্জ রাখছে, সে ছাড়া কারও তো লাভ করা কঠিন। এই বাজারটাকে প্রতিযোগিতামূলক করার পদক্ষেপ না নিলে লোকসানই স্বাভাবিক চিত্র থাকবে।
শেয়ার বিজ: মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সার্ভিস চার্জ নাকি অনেক বেশি। এ বিষয়ে আপনাদের মতামত কী?
তানভীর এ মিশুক: অনেক বেশি। আমরা একমত। তবে আমাদের প্রতিষ্ঠান বাজারের সবচেয়ে কম চার্জ নিয়ে থাকে। এটা একদম সরকারস্বীকৃত সত্য। আমরাই প্রথম কিছু সেবায় চার্জ ফ্রি করে দিয়েছি। ইউটিলিটি বিল জমা দেয়ার ক্ষেত্রে আমরাই প্রথম বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া শুরু করি। এরপর আমরা সিঙ্গেল ডিজিট ক্যাশ আউট চার্জ চালু করি। কিন্তু তারপরও আমরা মনে করি, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রচলিত চার্জ বেশি। এখন সমস্যা হলো, আমি চাইলেই এটা কমাতে পারব না। বরং এই চার্জ বাড়ানোর জন্য আমার ওপর চাপ আছে। এজেন্টকে আমি কমিশন কম দিই, তাই সে আমার পণ্য বিক্রি করতে চায় না। ফলে সেদিক থেকে আমার ওপর চার্জ বাড়ানোর চাপ আছে। এখন সর্বোচ্চ চার্জটা সরকার নির্ধারণ করে না দিলে আমরা এই চাপ থেকে বেরিয়ে চার্জ কমাতে পারব না।
শেয়ার বিজ: ক্রিপটোকারেন্সি এমএফএস ব্যবসায় কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি?
তানভীর এ মিশুক: ‘নগদ’ সবসময় নতুন প্রযুক্তির পক্ষে। নতুন প্রযুক্তিই পারে দেশকে এগিয়ে নিতে। তবে এখনও ক্রিপ্টোকারেন্সি বাংলাদেশে অনুমোদিত নয়। সেই অনুমোদন পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রস্তুত আছি।
শেয়ার বিজ: অর্থ পাচারের অভিযোগ শোনা যায়। এর কারণ কী?
তানভীর এ মিশুক: আমরা নিজেদের কথা বলতে পারি। আমাদের কোনোরকম বৈদেশিক লেনদেন নেই। আমরা যেসব পণ্য ব্যবহার করি, তাও আমাদের দেশের পণ্য। ফলে আমরা অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ অবস্থানে আছি। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থানও শক্ত। তবে আমরা অন্য কারও ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারি না।