উদ্ভাবন ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জোর দিচ্ছে বিকাশ

বিকাশ গত ১১ বছরে বাংলাদেশের ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ, অর্থাৎ প্রায় ছয় কোটি ৩০ লাখ গ্রাহক নিয়ে বিকাশ একটা বিশাল পরিবার। গুগল করা বা স্কাইপ করার মতো এদেশে বহু আগে থেকেই টাকা লেনদেনের সমার্থক হয়ে গেছে ‘বিকাশ করা’। ব্যাপারটি বিনিয়োগকারীদেরও আকৃষ্ট করেছে। তাই ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সেরা বিনিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান বিকাশ।

২০১৩ সালে বিকাশ বিশ্বব্যাংকের অন্তর্গত ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে বিনিয়োগ পেয়েছিল। এর এক বছর পর বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বিনিয়োগ করে বিকাশে। ২০১৮ সালে জ্যাক মা’র অ্যান্ট গ্রুপ বিকাশের শেয়ারহোল্ডার হয়। আর ২০২১ সালের নভেম্বরে জাপানের প্রযুক্তি খাতের বৃহত্তম বিনিয়োগ কোম্পানি সফটব্যাংক ভিশন ফান্ডের বিনিয়োগ পায় বিকাশ।

বিকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কামাল কাদীর মনে করেন, বিকাশের এক দশকের নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রম আর গ্রাহকদের আস্থার আরেকটি স্বীকৃতি হলো সফটব্যাংকের এই বিনিয়োগ। তিনি মনে করেন, বিকাশের এই সাফল্য আসলে বাংলাদেশের অগ্রসরমাণ অর্থনীতিরও স্বীকৃতি। সফটব্যাংকের এই বিনিয়োগ শুধু বিকাশের প্রাপ্তি নয়, এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার প্রতি সমর্থন। পাশাপাশি ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশের উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবকদের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পথও সুগম করেছে বিকাশ।

রূপান্তরে প্রভাব: কামাল কাদীর বলেন, ‘আমরা মানুষের লেনদেনে স্বাধীনতা ও সক্ষমতা এনে দিয়ে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পেরে বিকাশ আনন্দিত।’

মানি ইন মোশন এলএলসি’র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান বিকাশের মালিকানায় আছে ব্র্যাক ব্যাংক। স্যার ফজলে হাসান আবেদ এবং ব্র্যাকের সম্পৃক্ততা শুরুতেই গ্রাহকের আস্থা অর্জনে সাহায্য করে বিকাশকে। তবে বিকাশ এগিয়ে গেছে তার নিজস্ব উদ্ভাবন, আধুনিকতম প্রযুক্তির ব্যবহার ও সেবার বৈচিত্র্য নিয়ে, যা একইসঙ্গে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করেছে।

কেস স্টাডি: বিকাশের সাফল্য এখন প্রায়ই কেস স্টাডি হিসেবে ব্যবহƒত হয়। নিজস্ব উদ্ভাবন ও আধুনিকতম প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দেশীয় মেধাবীদের কাজে লাগিয়ে বিকাশ যে বিশ্বমানের আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, তা এখন অন্যান্য স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা।

শুরু থেকেই বিকাশের ডিএনএ’তে ছিল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। ১১ বছর আগে যাত্রা শুরুর সময় বিকাশের লক্ষ্য ছিল ব্যাংকিং সেবার বাইরের মানুষদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে নিয়ে আসা। বর্তমানে শুধু ব্যাংকিং সেবার বাইরের জনগোষ্ঠীই নয়, ব্যাংকিং সেবা পাওয়া গ্রাহকরাও বিকাশ ব্যবহার করে নানা সেবা গ্রহণ করছেন। এ প্রসঙ্গে কামাল কাদীর বলেন, বিকাশ মূলত প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সব নীতিমালা অনুসরণ করেই নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।

প্রথম দিকে বিকাশ মৌলিক সেবা, যেমন টাকা পাঠানো এবং পেমেন্ট গ্রহণ করার দিকে মনোযোগী ছিল। পরবর্তী সময়ে আরও গ্রাহকবান্ধব সেবা চালু করে। যেমন, ব্যাংক-টু-বিকাশ মানি ট্রান্সফার, রেমিট্যান্স সেবা, ডিজিটাল পে-রোল ডিজবার্সমেন্ট বা বেতন বিতরণ, ডিজিটাল ন্যানো লোন, মাসিক সঞ্চয় স্কিম এবং অনুদান প্রদানসহ অসংখ্য সেবা যুক্ত করেছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অন্যতম বড় খাত তৈরি পোশাকশিল্প। এ খাতের কর্মীদের বেতন বিকাশে পাঠানোর মাধ্যমে পুরো বেতন ব্যবস্থাপনা আরও সহজ ও নিরাপদ হয়েছে। এর সুফল পাচ্ছেন কর্মী ও কারখানার মালিক উভয় পক্ষই। পাশাপাশি ডিজিটাল লেনদেনের ইকোসিস্টেম তৈরি করতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোতে স্থাপিত ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলোয় বিকাশ পেমেন্টের ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। কর্মীরা বিকাশে বেতন পেয়ে বিকাশ দিয়েই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটা করা, বাড়িতে টাকা পাঠানো, মোবাইল রিচার্জ, বাড়িভাড়া ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধের মতো ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করতে পারছেন অনায়াসে।

বিকাশের সামাজিক প্রভাব: বিকাশ এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ২০২০ সালে কভিড-১৯ মহামারি চলাকালে বিকাশ-এর মতো এমএফএস সেবা সরকারিভাবে জরুরি সেবা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ সময় সরকারি প্রণোদনা থেকে শুরু করে সামাজিক সুরক্ষা খাতের বিভিন্ন ভাতা, বৃত্তি ইত্যাদি সরাসরি নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাওয়ার সুযোগ অসংখ্য গ্রাহকের জীবনকে করেছে স্বস্তিদায়ক।

২০২০ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) ‘ইমপ্যাক্ট অব মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ইন বাংলাদেশ: দ্য কেস অব বিকাশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিকাশের ভূমিকার বিষয়টি উঠে আসে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিকাশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করেছে, পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে। এটি শহুরে ও গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, নারীদের ক্ষমতায়ন করেছে এবং অভিঘাত মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কেএস মুরশিদ বলেন, গবেষণায় বিকাশের নানা ধরনের প্রভাব সম্পর্কে বেশ চমকপ্রদ ফলাফল পাওয়া গেছে, যার মধ্যে সঞ্চয় এবং নারীর ক্ষমতায়নে বিকাশের ইতিবাচক প্রভাব উল্লেখযোগ্য। মুরশিদ বলেন, খানা পর্যায়ে পারিবারিক আয় এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধিতে বিকাশ শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে।

স্বীকৃতি: ২০১৭ সালে বিকাশ ফরচুন ম্যাগাজিনের চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড তালিকার ৫০টি কোম্পানির মধ্যে স্থান করে নেয়। সামাজিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বীকৃতিস্বরূপ এই তালিকায় ২৩তম স্থানে নাম রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তালিকায় মাইক্রোসফট, ভলভো ও আইবিএমের মতো প্রতিষ্ঠানের চেয়েও এগিয়ে ছিল বিকাশ।

২০১৮ সালে চীনের অ্যান্ট ফিন্যান্সিয়ালের (বর্তমান নাম অ্যান্ট গ্রুপ) বিকাশে বিনিয়োগ ছিল একটি বড় চমক।

২০২১ সালের নভেম্বরে বিশ্বসেরা প্রযুক্তি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান সফটব্যাংক বিনিয়োগ করে বিকাশে। সফট ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজার্সের ম্যানেজিং পার্টনার গ্রেগ মুন বলেন, ‘একটি শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানো অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি, ডিজিটাল লেনদেনের নিরাপদ ও সুবিধাজনক পদ্ধতির মাধ্যমে বিকাশ বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছে।’

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি দেশেও বিকাশ অর্জন করেছে সেরা ব্র্যান্ড এবং সেরা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি। বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম কর্তৃক টানা তৃতীয়বার বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড ও এবং নিলসন বাংলাদেশ এর জরিপে টানা দ্বিতীয়বার সেরা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বিকাশ।

দেশের বৃহত্তম মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা হিসেবে বিকাশের অবস্থান নিয়ে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ইশতিয়াক মাহমুদ বলেন, ‘এ খাতে অবশ্যই প্রতিযোগিতা হবে। তবে বিকাশের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। আমি বিশ্বাস করি, বিভিন্ন ধরনের পেমেন্ট সেবার পাশাপাশি রেমিট্যন্স, ইন্স্যুরেন্স পেমেন্ট প্রভৃতি নানা সেবায় ক্রমাগত উন্নতি ও উদ্ভাবন অব্যাহত রাখবে বিকাশ। কারণ, এটিই বিকাশের মূল শক্তি বা সক্ষমতা।’

তিনি আরও বলেন, ‘কর্পোরেট সুশাসনকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং কমপ্লায়েন্স নীতিমালা মেনে ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করায় বিকাশের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিত হচ্ছে। বিকাশ যদি এই মূল্যবোধ এবং কমপ্লায়েন্স মেনে চলার প্রতি একাগ্র থাকে, তাহলে আরও সফলতায় সমৃদ্ধ হবে। প্রতিযোগিতা বিকাশকে আরও উদ্ভাবনী করবে, দুর্বল নয়।’

বিকাশ কিন্তু তার কাজে বিশ্রাম নিচ্ছে না, বরং এটা মাথায় রাখছে যে, সাফল্য একটি ম্যারাথন, স্প্রিন্ট নয়।

এ প্রসঙ্গে কামাল কাদীর বলেন, ‘আমরা এগিয়ে আছি এবং আমরা তা অর্জন করেছি। কিন্তু এটিই যথেষ্ট নয়। আমাদের দৌড়াতে হবে এবং আরও কাজ করে যেতে হবে।’

এশিয়ামানি’র প্রতিবেদন অবলম্বনে