বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা

আরাফাত রহমান: প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চারগুণ। আত্মহত্যা হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ।

চিকিৎসকরা আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। সহায়তাকারী আত্মহত্যা হলো যখন একজন ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে পরামর্শ বা পরোক্ষভাবে অন্য কোনো সরঞ্জাম দিয়ে মৃত্যুর জন্য সাহায্য করে। এখানে একজন ব্যক্তি অন্য একজন ব্যক্তির মৃত্যুর আনুষ্ঠানিকতায় আরও সক্রিয় ভূমিকা নেয়।

অনেক সময় আত্মহত্যার সঙ্গে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে। এশিয়াতে মানসিক রোগের হার পশ্চিমা দেশের চেয়ে অনেক কম। যাদের সাইকিয়াট্রিক ইউনিটে ভর্তি করা হয়, তাদের অনেকের পূর্ণ আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকে। আত্মহত্যার মাধ্যমে যারা মারা যায় তাদের প্রায় অর্ধেকের মধ্যে জটিল ডিপ্রেশন থাকে। এছাড়া অন্য কোনো মানসিক রোগ যেমন বাইপোলার ডিসঅর্ডার আত্মহত্যার জন্য ২০ গুণের বেশি ঝুঁকি বাড়ায়। অন্যান্য অবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সিজোফ্রেনিয়া, ব্যক্তিত্বের রোগ, দ্বিপক্ষীয় ব্যাধি, মোটা হওয়াজনিত ব্যাধি এবং ট্রোমাউত্তর স্ট্রেস ডিসঅর্ডার। সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেন।

যেসব দেশ বেশি পরিমাণে অ্যালকোহল ব্যবহার করে এবং বারের ঘনত্ব বেশি সেখানে সাধারণত আত্মহত্যার হার অনেক বেশি হয়ে থাকে। মদ্যপায়ী যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারা সাধারণত পুরুষ, বয়স্ক, এবং অতীতে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। যারা হেরোইন ব্যবহার করে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যু যারা ব্যবহার না করে তাদের তুলনায় প্রায় ১৪ গুণ বেশি হয়। বয়ঃসন্ধিকালীন যারা অ্যালকোহলের অপব্যবহার করে, স্নায়বিক ও মানসিক ব্যাধি তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

কোকেন এবং মেথামফেটামিনের অপব্যবহার আত্মহত্যার সঙ্গে উচ্চতর সম্পর্ক রয়েছে। যারা কোকেন ব্যবহার করে তাদের প্রত্যাহার পর্যায়ে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। ধূমপান আত্মহত্যার ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত। কেন এটি বিদ্যমান তার কোনো প্রমাণ নেই; তবে এটা অনুমান করা হয় যে, যারা ধূমপান করতে পছন্দ করে তাদেরও আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। ধূমপানের ফলে যে স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো ঘটে তা মানুষকে তাদের জীবন শেষ করতে অনুপ্রাণিত করে এবং ধূমপান মস্তিষ্কে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি করে। ১২ থেকে ২৪ শতাংশ জুয়াড়ি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তাদের স্বামী/স্ত্রীর মধ্যে আত্মহত্যার হার সাধারণ জনসংখ্যার তুলনায় তিনগুণ বেশি।

আত্মহত্যাপ্রবণতা এবং শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে, যেমন-দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, মস্তিষ্কের আঘাত, ক্যানসার, কিডনি ব্যর্থতা, এইচআইভি এবং সিস্টেমেটিক লেপাস ইরিথেমাটোসাস। ক্যানসার নির্ণয়ের পরে প্রায়ই আত্মহত্যার পরবর্তী ঝুঁকি দ্বিগুণ। বিষণন্নতা এবং মদ অপব্যবহারের জন্য আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে যায়। ঘুমের সমস্যা যেমন ইনসমনিয়া আত্মহত্যার ঝুঁকির কারণ হিসাবে মনে করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা বিষণন্নতা-সংক্রান্ত ঝুঁকির কারণ হতে পারে। অন্যান্য বেশ কয়েকটি মেডিকেল অবস্থা যেমন মানসিক অস্বাভাবিকতা, হাইপোথাইরয়েডিজম, আলঝেইমার রোগ, মস্তিষ্ক টিউমার এবং অনেক ওষুধ থেকে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়: যেমন-হতাশা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা, বিষণœতা এবং উদ্বিগ্নতা। সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া যা আগে ছিল এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতাও ভূমিকা পালন করে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্যদের বোঝা হওয়ার অনুভূতি গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যা যার কারণটি হলো যে ব্যক্তি মনে করে যে সে সমাজের অংশ নয় তা মূলত অহঙ্কারী আত্মহত্যা বলে পরিচিত।

সাম্প্রতিক জীবনের চাপ যেমন-পরিবারের সদস্য বা বন্ধুকে হারানো, চাকরির ক্ষতি বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা যেমন একা বেঁচে থাকা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। যারা বিয়ে করেনি তারা আরও ঝুঁকিপূর্ণ। ধার্মিক হওয়ার ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকি কমে যায়। অনেক ধর্ম আত্মহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং অধিকতর যৌক্তিকতা ধর্ম দিতে পারে। মুসলমানদের মধ্যে যারা ধার্মিক তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার নি¤œ। প্রহসন বা কুসংস্কার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেউ কেউ নিজের জীবন নিতে পারে। শৈশবের যৌন নির্যাতন এবং সৎ পিতামাতার যতেœ লালিত পালিত হওয়ার ফলেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যৌন নিপীড়ন সামগ্রিক ঝুঁকির মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ অবদান রাখে বলে মনে করা হয়।

দারিদ্র্য আত্মহত্যার ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত। আপেক্ষিক দরিদ্রতা বৃদ্ধি একজন ব্যক্তির চারপাশে আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। মিডিয়া, যার মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেট, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আত্মহত্যার বিবরণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তখন যখন তার সঙ্গে পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজ, আত্মহত্যার প্রশংসা করা বা রোমান্টিসাইজ করা হয়। যখন একটি নির্দিষ্ট উপায়ে কী করে নিজেকে হত্যা করা যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়, আত্মহত্যার এই পদ্ধতি সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে বৃদ্ধি পেতে পারে।

আত্মঘাতী পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, যেমন-গলায় ফাঁস নিয়ে, বিষাক্ত কীটনাশক পান করে এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যা। ৫৬টি দেশের মধ্যে একটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দেশের মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার পদ্ধতিটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি ছিল, যার মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৯ শতাংশ নারী আত্মঘাতী ছিল। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার ৩০ শতাংশ কীটনাশক বিষক্রিয়া থেকে ঘটতে পারে, যার অধিকাংশই উন্নয়নশীল বিশ্বে ঘটতে দেখা যায়।

অনেক দেশে নারী প্রায় ৬০ শতাংশ এবং ৩০ শতাংশ পুরুষ মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের মাধ্যমে আত্মহত্যা করে থাকে। অনেকে অপরিকল্পিত এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বের সময়কালে আত্মহত্যা ঘটিয়ে থাকে। মৃত্যুর হার পদ্ধতি অনুসারে পরিবর্তিত হয়: আগ্নেয়াস্ত্র ৮০-৯০ শতাংশ, পানিতে ডুবে ৬৫-৮০ শতাংশ, ৬০-৮৫ শতাংশ গলায় ফাঁস নিয়ে, ৪০-৬০ শতাংশ গাড়ি দুর্ঘটনা, ৩৫-৬০ শতাংশ লাফিয়ে, ৪০-৫০ শতাংশ পুড়িয়ে, কীটনাশক পান করে ৬-৭.৫ শতাংশ ও ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে ১.৫-৪ শতাংশ। আত্মহত্যার সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি বেশিরভাগ সফল পদ্ধতির থেকে ভিন্ন। উন্নত বিশ্বে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রচেষ্টাগুলো ড্রাগ ওভারডোজের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।

নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে দেখা যায়, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮৭ থেকে ৯৮ শতাংশ আত্মহত্যাকর্ম সংঘটিত হয়। এছাড়া আত্মহত্যাজনিত ঝুঁকির মধ্যে অন্যান্য বিষয়াদিও আন্তঃসম্পৃক্ত। তš§ধ্যে-নেশায় আসক্তি, জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে না পাওয়া, আত্মহত্যায় পারিবারিক ঐতিহ্য অথবা আগেকার মাথায় আঘাত অন্যতম প্রধান উপাদান।

আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব, দরিদ্র্যতা, গৃহহীনতা এবং বৈষম্যতাজনিত উপাদানগুলো আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে থাকে। দারিদ্র্যতা সরাসরি আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িত নয়। কিন্তু এটি বৃদ্ধির ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় এবং উদ্বেগজনিত কারণে আত্মহত্যার উচ্চস্তরে ব্যক্তি অবস্থান করে। শৈশবকালীন শারীরিক ইতিহাস কিংবা যৌন অত্যাচার, অথবা, কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সময় অতিবাহিতজনিত কারণও ঝুঁকিগত উপাদান হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে প্রেমে ব্যর্থতা বা প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। পরিবার বা সমাজ স্বীকৃতি না দেয়ায় প্রেমিক যুগলের সম্মিলিত আত্মহত্যার ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে।

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতাসংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভবপর। যখন একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার বিষয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা শুরু করেন, তখনই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মনোবিদরা বলেন, যখন ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা জানামাত্রই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে কাউকে জানানো। ভুক্তভোগী ব্যক্তি ইতোমধ্যেই যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে কীভাবে আত্মহত্যা করবেন, তা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব ব্যক্তি দুশ্চিন্তায় পড়েন তারা আত্মহত্যায় সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দলের অন্তর্ভুক্ত। উন্নত দেশে চরম মুহূর্তজনিত হটলাইন রয়েছে যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাদের চিন্তাভাবনা এবং আত্মহত্যার পরিকল্পনার কথা জানায়। হটলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে ভুক্তভোগী তার সমস্যার সমাধানের পথ সম্পর্কে অবহিত হয়ে আত্মহত্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিজেকে ভালোবাসাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আত্মহত্যা প্রতিরোধ হলো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনা কমাতে যৌথ প্রচেষ্টা। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে সেতু এবং পাতাল রেলপথগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবহার করা। মাদকদ্রব্য ও মদ্যপানের অভ্যাসজনিত বিষয়গুলোর চিকিৎসা করা যা বিষণœতা এবং যারা অতীতে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল তাদের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে। প্রতিরোধমূলক কৌশল হিসেবে মদ অ্যাক্সেস হ্রাস করা যেতে পারে। অল্প বয়স্ক ব্যক্তি যারা আত্মহত্যার বিষয়ে সাম্প্রতিকভাবে চিন্তা করেছেন তাদের ক্ষেত্রে আচরণগত থেরাপি আশাব্যঞ্জক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমাতে সক্ষম হলে আত্মহত্যার হার হ্রাস পেতে পারে। সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা বয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।

সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ

সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়