সংকট উত্তরণে কৃষি ও বাণিজ্য খাত সমৃদ্ধ করুন

মো. রায়হান আলী: দেশজুড়ে ভোজ্য ও জ্বালানি তেল এবং গ্যাস-বিদ্যুতের চলমান সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এসবের দাম বৃদ্ধির কারণে এদেশেও দাম সমন্বয় রেখে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতির কারণ হিসেবে এটাও জানা যায়, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এর বিরূপ প্রভাব বিশ্ববাজারকে করেছে ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে তেল-গ্যাস সংকট দেশের মানুষকে অসহনীয় করে তুলেছে। বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের কারণে সারাদেশে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে এই পরিস্থিতি। চারদিকে বিদ্যুতের হাহাকার। শহরে একটু বিদ্যুতের নাগাল পেলেও গ্রামে তো হুট করে এসে আবার চলে যায়। শিডিউল অনুযায়ী কয়টার সময় লোডশেডিং শুরু হয়ে যে কয়টা পর্যন্ত চলবে, তার ইয়ত্তা নেই! খাতা-কলমে শিডিউল থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। অফিস-আদালত ও কৃষি ক্ষেত্রে ঘটছে কর্মের সময় বিপর্যয়! সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কেউ কাজ করতে পারছে না। করোনার সংকট কাটিয়ে উঠতে দেশের মানুষ যখন হামাগুড়ি দিয়ে নতুন উদ্যমে পরিকল্পনামাফিক নিয়মিত কাজকর্মে ফিরছিল, তখন আবার চলমান নতুন সংকটের হানা!

দেশে বিদ্যমান সংকটের মধ্যে প্রধান সংকট হলো বিদ্যুৎ। আর এই বিদ্যুৎ সংকটে অসহনীয় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। চলমান লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষি ক্ষেত্রে রোপা আমন ধানে সেচ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। সারাদেশেই লোডশেডিং ব্যবস্থাপনায় হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়ম মেনে লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয়া হলেও বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন।

সরকার দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কথা বললেও বাস্তবে এ শিডিউলের বিপর্যয় হচ্ছে। ফলে প্রয়োজন অনুযায়ী কৃষকের ধান ক্ষেতে সেচযন্ত্র চালানো যাচ্ছে না। এতে রোপা আমন ধান বোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অনেক এলাকায় লোডশেডিংয়ের কারণে বন্ধ বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রগুলো, যে কারণে চলতি বীজতলা ও রোপা আমন রোপণের জমি তৈরি করতে পারছে না কৃষকরা। ফলে পূরণ হবে না লক্ষ্যমাত্রা। এ লোডশেডিংয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে মাছের হ্যাচারি মালিকরা। একদিকে বিদ্যুৎবিভ্রাট, অন্যদিকে সূর্যের খরতাপে মাছের পোনা উৎপাদনে ধস নেমেছে। অনাবৃষ্টি আর বিদ্যুতের লুকোচুরিতে কৃষকরা দিশাহারা।

পত্রিকার তথ্যানুযায়ী, ‘রাজধানীতেই কোনো কোনো এলাকায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় সাত থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের নাটোর, রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও নওগাঁ এলাকায় হিমাগারের রাখা পণ্যের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নেসকো ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন সব এলাকাতেই লোডশেডিংয়ের কারণে কৃষকরা জমিতে সেচ দিতে পারছেন না।’ কৃষক ও শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, লোডশেডিংয়ের সরকারি সূচির কথা বলা হলেও সেটা মানা হচ্ছে না। তাদের মতে, বিদ্যুতের অভাবে আমন ও মাছ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ছিল সাড়ে ২৪ টাকা। সরকারি পর্যায়ে ধানের দাম ২৬ টাকা কেজি। প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কৃষির উৎপাদন ব্যয়। সামগ্রিক কারণে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছে হু-হু করে। দশকের পর দশক কৃষকরা লোকসানের পরও নিরলসভাবে ফসল উৎপাদন করে যাচ্ছে দেশের খাদ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএওর ‘বিশ্ব পরিসংখ্যান পকেট বুক, ২০১৯’-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষক ২০১৭ সালে যে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছেন, তার আর্থিক মূল্য প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। ২০ বছর আগে কৃষক যে অবদান অর্থনীতিতে রাখতেন, এখন তার দ্বিগুণ রাখেন। বাংলাদেশের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় এক মিটার থেকে ৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও দেশের সব ভূমি সব ধরনের ফসল ফলানোর উপযুক্ত নয়। মোট জমির মাত্র ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ প্রায় ৮৫ দশমিক ৭৭ লাখ হেক্টর জমির ৭১ শতাংশে বোরো ধান চাষ করা হয়। মোট জমির প্রায় ৬০ শতাংশ মালিক নিজেই চাষ করেন। প্রায় ৭৫ শতাংশ জনসংখ্যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তবে উন্নত দেশে এ নির্ভরতার হার ২০-২৫ শতাংশ। এদেশের কৃষকদের অধিকার ও কৃষি ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। কৃষি উন্নয়নের জন্য ৯০ দশকে শস্য বহুমুখীকরণ, ১৯৯৭ সালে বীজনীতি, খাদ্যনীতি ২০০৬, জাতীয় কৃষি ২০১৮, সেচনীতি ২০১৮, পানি উন্নয়ন বোর্ড নীতি ২০১৮, জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ এবং কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সপ্তম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ছে। কিন্ত প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের প্রশিক্ষণের অভাব ও  উৎপাদনের ওপর উপযুক্ত গবেষণা না থাকার ফলে কৃষক ও কৃষি বিভাগ আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না।

দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাণিজ্য খাত। বাণিজ্য খাতে তেল, গ্যাস, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাণিজ্যতে কাঁচামাল তৈরিতে এসব প্রধান ভূমিকা রাখে। স্বভাবতই এসবের দাম বৃদ্ধিতে টোটাল বাণিজ্য খাতে এর উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে একদিকে কোম্পানিগুলো বিপাকে রয়েছে, অন্যদিকে ক্রেতারাও বিপাকে। মাঝখান থেকে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সুবিধা লুফে নিচ্ছে। আর এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। শ্রম ও কর্মের মূল্য বৃদ্ধি না হলেও বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সব নিত্যপণ্যের। আয়ের সঙ্গে মানুষের ব্যায়ের তারতম্য যেন মিলছেই না। শিল্প খাত ও সাধারণ জনগণ উভয়েই বিপাকে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শিল্পকারখানার উৎপাদন কমেছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানির খরচ বেড়ে গেছে। বেশি উৎপাদন করলে বেশি খরচ। সেজন্য আমরা শিল্পকারখানাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ রেশনিং করতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু সেভাবে হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, শিল্পকারখানায় লোডশেডিং হচ্ছে। বাসাবাড়িতে লোডশেডিং। আমাদের মনে হচ্ছে, এই জায়গায় একটু সংশোধন করা লাগবে। অন্যদিকে গ্যাসনির্ভর শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ কম। গ্যাস তো নিশ্চিত করা দরকার। লোডশেডিং হবে, আবার গ্যাসের চাপও কম থাকবেÑএকসঙ্গে দুটো হওয়া তো উচিত নয়।’

চলমান সংকট দেশীয় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। তাই দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচলে ও উন্নয়নে দেশের কৃষি খাতকে আরও উন্নত ও আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প ও কল-কারখানার সাময়িক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত তা থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মিলিত প্রয়াসে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

আইনজীবী

জজ কোর্ট, খুলনা