সুমাইয়া বিনতে হোসাইন: বর্তমানে প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে বিনিময় হার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে ২০২১ সালে ১ ডলার সমান ছিল ৮৫ টাকা এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ টাকা ৪৮ পয়সায়। ফলে দেশে খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একটা দেশ কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় তথা জনগণের সব চাহিদা একটা দেশ একাই মেটাতে পারে না বা নিজের ভৌগোলিক সীমানায় উৎপাদন করতে পারে না ফলে ভিন্ন দেশের সঙ্গে লেনদেন করতে হয় আর যেহেতু ভিন্ন দেশে ভিন্ন মুদ্রা প্রচলিত এবং নিজের দেশের মুদ্রা অন্য দেশে যেহেতু চলবে না তখন চলে আসে এক্সচেঞ্জ রেটের বিষয়। মূলত দুটি ভিন্ন দেশে কী হারে কেনাবেচা হয় অর্থাৎ যে হারে একটি দেশের প্রচলিত মুদ্রা অন্য দেশের প্রচলিত মুদ্রার সঙ্গে বিনিময় করা যায় তাকে বিনিময় হার বলে। এই এক্সচেঞ্জ রেট বা বিনিময় হারটা নির্ধারণ হতে পারে তিন ভাবে। প্রথমটা হলো ফ্ল্যাক্সজিবল বা ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট, যেখানে সরকারের কোনো হাত থাকে না; বরং এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারিত হয় সমাজে বসাবসরত নাগরিকের চাহিদা এবং জোগানের সমতার মধ্য দিয়ে। এদিকে বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়ে, যখন দেশে কোনো পণ্য আমদানি করা হয় অথবা নিজ দেশের জনগণ যখন অন্য দেশের জায়গাজমি কিনে ইত্যাদিতে বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়ে বা বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে যখন রপ্তানি করা হয় নিজ দেশের পণ্য অথবা অন্যদেশ যখন ইনভেস্ট বা বিনিয়োগ করে তখন দেখা যায় বিদেশি মুদ্রা হাতে আসে তথা মুদ্রার জোগান দেখা যায়। যদিও মুক্ত অর্থনীতির যেসব সুবিধা আছে তা এই এক্সচেঞ্জ রেটেও দেখা যায়। যার কারণে বাংলাদেশসহ প্রায় প্রতিটা দেশে এই এক্সচেঞ্জ রেটের ব্যবহার দেখা যায়। তারপরও এর অসুবিধা হলো বার বার বিনিময় হার পরিবর্তন হয়। ফলে অর্থনীতিতে একটা অনিশ্চয়তা দেখা গেলে, কোনো ধরনের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আবার স্পেকুলেশন হয় তথা ভবিষ্যতে বিদেশি মুদ্রার দাম বেড়ে যাবে ভেবে জনগণের বিদেশি মুদ্রার প্রতি চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে বিদেশি মুদ্রার প্রকৃতপক্ষেই দাম বেড়ে যায়, যাকে অর্থনীতিতে সেল্ফফুল সিলিং প্রোফেসিংও বলা হয়।
দ্বিতীয়টি হলো এমন ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতি যেখানে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার নির্ধারণ করে। যেমন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিল এক ডলার সমান ৯০ টাকা এবং এ দামেই দ্রব্য লেনদেন হলে একে বলা হয় ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো বাজার অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় থাকে এবং অনিশ্চয়তা থাকে না তবে এর বড় অসুবিধা হলো সরকারকে সর্বদাই ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে বেচাকেনায় লিপ্ত থাকতে হয়, যার প্রভাব দেখা যায়, মুদ্রা বিনিময়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেটে যখন বিদেশি মুদ্রা বা ডলারের চাহিদা বেড়ে যায় তখন ডলারের দামে ঊর্ধ্বমুখী একটা চাপ দেখা দেবে, যেহেতু ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট, তাই সরকার চাইবে এক্সচেঞ্জ রেট আগের মতোই রাখতে আর এই জন্য সরকার ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে ডলার বিক্রি করবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অতিরিক্ত ডলারের জোগান দ্বারা অতিরিক্ত ডলারের চাহিদা মিটে গেলে ডলারের দাম বাড়বে না। এর ফলে কেন্দ ীয় ব্যাংক পাচ্ছে টাকা, আর অন্যান্য ব্যাংকে আমানত (ডিপোজিট) কমে যাচ্ছে, যার ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক কম টাকা লোন হিসেবে দিতে সক্ষম হবে। তাছাড়া এই এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতিতে কালো বাজারের সৃষ্টি হয় যেখানে কালো বাজারের সঙ্গে যারা জড়িত তারাই টাকা উপার্জন করবে কিন্তু ব্যাংক বা সরকার যে লাভ বা অনানুষ্ঠানিক ট্যাক্স পেতে পারতো তা আর পাবে না। এখন এই দুটি এক্সচেঞ্জ রেট পদ্ধতিকে একত্রিত করে যে অন্য এক পদ্ধতির তৈরি হয়েছে, একে বলা হয় ম্যানেজ ফ্লোট অর ডার্টি ফ্লোট। যেখানে সরকার সর্বোচ্চ এবং সর্বনি¤œ একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয় যে এক্সচেঞ্জ রেট বা বিদেশি মুদ্রার দাম বা বিনিময় হারটা কত হতে কত হবে এবং এই সীমার বাইরে গেলে সরকার হস্তক্ষেপ করবে। একটা দেশের অর্থনীতিতে এক্সচেঞ্জ রেটের ভূমিকা অপরিসীম যার ওপর নির্ভর করবে একটা দেশের বাণিজ্যিক ব্যবস্থা কেমন আর ওই দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান কেমন। তাই এই এক্সচেঞ্জ রেটকে সর্বদা সমতায় রাখা অত্যাবশ্যক যদিও আজকের বিশ্বে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এই এক্সচেঞ্জ রেটের অসমতার কারণে নানা অর্থনৈতিক সমস্যাসহ সামাজিক সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। আর এদিকে বাংলাদেশে বিনিময় হারের বাজারে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার কারণ বর্ধিত ঋণ চাহিদা, প্রণোদনা ঋণ সরবরাহ, বর্ধিত মূল্যের আমদানি, বর্ধিত আমদানি রপ্তানির তুলনায় কম রেমিট্যান্স। যদিও দেশে বছর প্রবৃদ্ধি টার্গেট ৭ দশমিক ৫ ছাড়িয়ে গেল। যেখানে উৎপাদন খাত ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে ব্যক্তি খাতে ভোগে দেখা গেছে ১৩ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এবং বিনিয়োগ হার মাত্র ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপির, রপ্তানি বাড়লেও ভোগ খেয়ে ফেলছে বেশির ভাগ অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা মাঝপথেই, আমাদের সঞ্চয় গত দুই বছরে ভাঙা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। তাছাড়া বৈশ্বিক ঘটনা, যেমন বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যর্থতাও আছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দুর্বলতম দেশ বিনিময় হারের যথাযথ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে বড় ব্যবসায়ীরা দপ্তর খুলেছেন, বড়রা আমদানি-রপ্তানি ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ছোটরা হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছেন অর্থ পাচারে। গত জুনে ইতিহাসের রেকর্ড ভেঙে অতিরিক্ত তারল্য পৌঁছে ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকায়। তখন ২ শতাংশ রেমিট্যান্স প্রণোদনা প্রত্যাহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে যে বিনিময় হার বেড়েই চলেছে তা সমতায় আনতে, বিনিময় হার যদিও মুদ্রানীতির উপাদান, কিন্তু একে মেরামত করতে এখন মুদ্রা ও রাজস্ব উভয় নীতির যন্ত্রপাতি প্রয়োগ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন করলেই আমদানি কমবে, আর বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়ে যাবে, এমন কোনো স্বতঃসিদ্ধ সূত্র নেই অর্থবিজ্ঞানে আর মুদ্রার সঞ্চালন বা বিয়োজন বা শুষে নেয়ার কাজ সবসময়ই সাময়িক সমাধান হতে পারে সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে প্রাণের স্পন্দন দিতে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেগুলো সবসময়ই অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। একটি দেশের মুদ াকে ব্যাপক পতন থেকে রক্ষা করে রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় বা বিদেশি বিনিয়োগের মতো দীর্ঘমেয়াদি রসদ জোগাতে হবে অর্থনীতির শিরা উপশিরায়, শুল্ক বা অশুল্ক সব বাণিজ্য বাধার বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে উপযুক্ত প্রতিষেধক, প্রয়োজনীয় আয় তুলে আনতে ব্যর্থ অর্থনীতির সূত্রে অদক্ষ বলে প্রমাণিত প্রকল্প ব্যয়ের হিড়িক, ঘুষ বাণিজ্য, অনিয়ন্ত্রিত ভোগ এবং দেশীয় পণ্যের প্রতি চাহিদা বাড়াতে হবে আর এক্ষেত্রে আমদানি বিকল্প- শিল্পের প্রতি জোরসহ সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়