আলু মজুত করে বিপাকে রাজশাহীর চাষিরা

মেহেদী হাসান, রাজশাহী: খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩০ টাকা। একই আলু পাইকারি বাজারে সাড়ে ১৯ থেকে ২০ টাকা! চাষিদের উৎপাদন ও হিমাগারে সংরক্ষণের খরচের হিসাবে প্রতি কেজি আলুতে গড়ে লোকসান সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ টাকা। মৌসুমের শুরুর দিকে বেশি দাম পেয়েও আলু বিক্রি না করে অধিক লাভের আশায় হিমাগারে মজুত করেছেন জেলার কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। চলতি বাজারে পাইকারিতে বস্তাপ্রতি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে আলু। লাভের আশায় আলু মজুত করে বিপাকে পড়েছেন রাজশাহীর চাষিরা।

এমন দরপতনের কারণে হিমাগারগুলোয় বর্তমানে ভরা মৌসুমেও কৃষক ও ব্যবসায়ীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। গত বছরের এ সময়ে যে পরিমাণ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ ছিল, এবার তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি আলু সংরক্ষণ করেছিলেন চাষিরা। বাজারে বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়লেও বাড়েনি আলুর দাম। এ পরিস্থিতিতে সংরক্ষণের ভাড়া আর আলু কেনার সময় ব্যবসায়ীকে ঋণ দেয়ার টাকা আদায় করতে না পেরে বিপদে পড়েছেন হিমাগার মালিকরা।

হিমাগার সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার আলুর দাম কম। হিমাগারে আলু নিতে আসছেন না অনেকে। এখন পর্যন্ত ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ আলু হিমাগারে পড়ে আছে। কৃষি বিপণন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৬টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে ৮০ লাখ বস্তা। ওজনের দিক দিয়ে ৪ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিক টন। চলতি বছরের জুন-জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাসে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২২৪ মেট্রিক টন আলু উত্তোলন করা হয়েছে। এখনও হিমাগারে পড়ে রয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ২৪৩ মেট্রিক টন আলু। তবে এই বিপুল পরিমাণ সংরক্ষিত আলু উত্তোলনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৫ নভেম্বর। কিন্তু ডিসেম্বর মাসের পুরোটাই চাষিদের জন্য সময় থাকবে বলে জানিয়েছে রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন।

চাষী, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, হিমাগারের খরচসহ প্রতি বস্তা (৬৫ কেজি) প্রকারভেদে আলুর খরচ পড়েছে ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। বর্তমান বাজারে আলুপ্রতি বস্তা ১ হাজার ২০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গড়ে বস্তাপ্রতি লোকসান গুনতে হচ্ছে ২৫০ টাকা। বাজারে আলুর যে দাম তাতে আরও মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। সঙ্গে আলু কিনতে ব্যবসায়ীদের দেয়া ঋণের টাকা এবং আলু রাখার ভাড়ার টাকা ওঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হিমাগার মালিকদের। লোকসান ঠেকাতে আলু রপ্তানির দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে কার্ডিনাল, ডায়মন্ড ও অ্যাস্টেরিক জাতের আলু বেশি চাষ হয়। গত কয়েক বছর থেকেই বাড়ছে আলুর চাষ। ২০২০-২১ মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। ভালো দামের আশায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩৬ হাজার ৬২৯ হেক্টর জমিতে চাষ হয় আলু। এসব জমি থেকে ৮ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের আশা করলেও পরে লক্ষ্যমাত্রা ৮ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করে কৃষি বিভাগ। সে সময় কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণেই এসব আলু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাহিদা কমে যায়। চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে আগের তুলনায় বেড়ে ৩৬ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন আলুর চাষ হয়। এতে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১২৭ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয় যা জেলার বিভিন্ন হিমাগারে রাখা হয়েছে। উদ্বৃত্ত আলু দৈনিক চাহিদা পূরণ ও বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে।

কয়েকজন চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বাজারে আলুর দাম গত বছরের তুলনায় কম। প্রতিকেজি ডায়মন্ড, কার্ডিনাল, এস্টারিক্স (লাল) জাতের আলু উৎপাদন খরচ পড়ে ১৫ টাকার বেশি। বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত আলুর উৎপাদন খরচ সাড়ে ১৬ থেকে ১৭ টাকা। বর্তমানে বাজারে যে দামে আলু বিক্রি হচ্ছে সে অনুযায়ী প্রতি কেজি আলুতে ২ টাকা ৫০ পয়সা এবং বাণিজ্যিক উৎপাদন ও কিনে মুজতকরা আলুতে সাড়ে ৪ টাকা লোকসান হচ্ছে। বাণিজ্যিক চাষিরাও যেখানে লোকসান গুনতে বাধ্য সেখানে সিন্ডিকেট মুনাফা করায় বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, বাজারের সঙ্গে চাষি পর্যায়ে ক্রয়-বিক্রয়ের বিশাল ফারাক হতে পারে না। সরকারের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

তানোর উপজেলা যোগীশহ এলাকার আলুচাষি রেজাউল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর ২০ বিঘা জমিতে আলুর চাষ করি। কোল্ড স্টোরেজে এখন আমার ১২শ বস্তা আলু আছে। বাজারে দাম ভালোই আছে কিন্তু পাইকারিতে দাম নেই।

একই উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের আলুচাষি ও ব্যবসায়ী আব্দুর রাকিব বলেন, প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৭ টাকা। ২৫ টাকা হিসেবে বিক্রি করতে পারলে বাঁচতাম। আমার ২৪শ বস্তা আলু বর্তমানে স্টোরে আছে। চলমান বাজারে বিক্রি করলে গায়ে গায়ে যাবে।

মধ্যস্বত্বভোগীদের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু বকর বলেন, বাজারে ২২ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আলু। আর পাইকারিতে সাড়ে ১৯ থেকে ২০ টাকা। এ হলো আমাদের দেশের সমস্যা; সিন্ডিকেটের পকেটে চাষিদের টাকা। পর্যাপ্ত আলু চাষ হলেও চাহিদাও আছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক নেই। চাষিরা এ কারণেই লোকসানে পড়ছেন। আমরা সরকারি দপ্তরে জানিয়েছি কৃষকের এ সমস্যা সমাধানের জন্য।

কী পরিমাণ আলু হিমাগারগুলোতে রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আলু হিমাগার থেকে বের করা হচ্ছে প্রতিদিনই। একটা রিপোর্ট করা হচ্ছে, ফাইনাল হয়নি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, রাজশাহীতে বাণিজ্যিকভাবে আলু সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। আলুর দাম কিছুটা কমে গেছে। এখনও দু-মাস সময় আছে আলুর দাম বাড়ার। সেপ্টেম্বর- অক্টোবর-নভেম্বরে আলুর দাম কিছুটা বাড়ে।