নামমাত্র উৎপাদনেও পূর্ণ ক্যাপাসিটি চার্জ

পাঁচ বছরে বাংলাক্যাটের পকেটে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা!

ইসমাইল আলী: বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাক্যাট। বর্তমানে এ গ্রুপের নিজস্ব পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া প্যারামাউন্ট গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে রয়েছে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এগুলোর মধ্যে তিনটি ডিজেলচালিত ও তিনটি ফার্নেস অয়েলের। তবে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বছরের বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকে। যদিও বসিয়ে রেখেই বছর বছর পূর্ণ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে কেন্দ্রগুলোর জন্য।

তথ্যমতে, নামমাত্র উৎপাদন করলেও বাংলাক্যাটের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য পাঁচ বছরে প্রায় চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)। এর মধ্যে ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল প্রায় দুই হাজার ৯৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোর। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এ গ্রুপটি।

বাংলাক্যাট গ্রুপের নিজস্ব পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৬০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের (ইউনিট-১, ২ ও ৩) উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট এবং বাংলা ট্র্যাক-১ ও ২ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৩০০ মেগাওয়াট। এছাড়া প্যারামাউন্ট বি.ট্র্যাক ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৪৯ শতাংশ রয়েছে বাংলাক্যাটের হাতে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা গ্রুপটির। সক্ষমতার ৮০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা থাকলেও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো বছরে দু-তিন শতাংশ বা তারও কম চলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছর প্রথম কুইক রেন্টাল কেন্দ্র দিয়ে বিদ্যুৎ খাতে যাত্রা শুরু করে বাংলাক্যাট। গ্রুপটির সাবসিডিয়ারি অ্যাক্রন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসেসের ফার্নেস অয়েলচালিত ইউনিট-১ বিদ্যুৎকেন্দ্র সে বছর চালু হয়। পাঁচ বছরের জন্য এ লাইসেন্স দেয়া হলেও পরে তা আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হয়। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মেয়াদ দাঁড়ায় ১০ বছর। গত ২৫ মার্চ সে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। তবে চলতি মাসে এ কেন্দ্রটির মেয়াদও নতুন করে দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।

চট্টগ্রামের জুলধায় ১০০ মেগাওয়াট কুইক রেন্টাল কেন্দ্রটি ২০১২ সালের ২৬ মার্চ উৎপাদন শুরু করে। এরপর প্রায় ছয় বছর একটি কেন্দ্রই ছিল বাংলাক্যাটের। এ ছয় বছরে কেন্দ্রটির জন্য বাংলাক্যাট ক্যাপাসিটি চার্জ পায় ৮৩৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছর উৎপাদনে আসে বাংলাক্যাটের দুটি ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। কুইক আইপিপি নামক এ কেন্দ্র দুটির উৎপাদন সক্ষমতা মোট ৩০০ মেগাওয়াট।

কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্থাপিত ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটির নাম বাংলা ট্র্যাক-১ এবং যশোরের নোয়াপাড়ায় ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটির নাম বাংলা ট্র্যাক-২। উৎপাদন শুরুর বছর কেন্দ্র দুটির সক্ষমতার ব্যবহার করা হয় যথাক্রমে ১৫ ও ২৬ শতাংশ। এটি ছিল কেন্দ্র দুটির সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার।

বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির জন্য পিডিবির ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় যথাক্রমে ১৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ও ১০০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আর সে বছর অ্যাক্রন ইউনিট-১ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ১২৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছর বাংলাক্যাটের পকেটে ক্যাপাসিটি চার্জ ঢুকে ৩৬৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

২০১৮-১৯ অর্থবছর প্যারামাউন্টের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের কেন্দ্র প্যারামাউন্ট বি.ট্র্যাক উৎপাদনে আসে। ওই অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য এক (০.০১) শতাংশ ব্যবহার হয়। আর বাংলা ট্র্যাক-১ ও ২ কেন্দ্র দুটির সক্ষমতার ব্যবহার হয় যথাক্রমে তিন ও ১৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছর বাংলাক্যাট ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে ৭৯৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছর অ্যাক্রোন ইউনিট-২ ও ৩ বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি উৎপাদনে আসে। ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র দুটি ১০০ মেগাওয়াট করে মোট ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। তবে শুরুর বছরই সক্ষমতার অর্ধেকও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়নি। আর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বাংলা ট্র্যাক-১ ও প্যারামাউন্ট বি.ট্র্যাকের উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার হয় শূন্য দশমিক শূন্য এক (০.০১) শতাংশ। আর বাংলা ট্র্যাক-২-এর সক্ষমতার ব্যবহার করা হয় ৯ শতাংশ।

সে অর্থবছর ছয় কেন্দ্রের জন্য বাংলাক্যাট ক্যাপাসিটি চার্জ পায় ৯৬৮ কোটি ১১ লাখ টাকা। ছয়টি কেন্দ্রের মধ্যে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে স্থাপিত প্যারামাউন্ট বি.ট্র্যাক কেন্দ্রটিতে ২০১৯-২০ অর্থবছর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ৯৪৪ টাকা ২১ পয়সা। আর বাংলা ট্র্যাক-১ কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৬০৬ টাকা আট পয়সা।

এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্যারামাউন্ট বি.ট্র্যাকের উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার হয় এক শতাংশ, বাংলা ট্র্যাক-১-এর দুই শতাংশ এবং বাংলা ট্র্যাক-২-এর ১৪ শতাংশ। এ তিন কেন্দ্রে ওই অর্থবছর ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে যথাক্রমে ১৮০ টাকা ৬৭ পয়সা, ১০৫ টাকা ৭২ পয়সা ও ৩১ টাকা ৩৮ পয়সা।

এর বাইরে ফার্নেস অয়েলচালিত অ্যাক্রোন ইউনিট-১-এর সক্ষমতার ব্যবহার হয় ২২ শতাংশ। বাকি দুই কেন্দ্রের সক্ষমতার মোটামুটি পুরোটাই ব্যবহার হয়। সে অর্থবছর বাংলাক্যাট ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে এক হাজার ১৪২ কোটি ছয় লাখ টাকা।

সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছর ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্যারামাউন্ট বি.ট্র্যাক এর উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার হয় ছয় শতাংশ, বাংলা ট্র্যাক-১-এর ৯ শতাংশ এবং বাংলা ট্র্যাক-২-এর ১২ শতাংশ। উৎপাদন বাড়ায় তিন কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি ব্যয় কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৫৩ টাকা ২৭ পয়সা, ৪২ টাকা ৯ পয়সা ও ৩৬ টাকা ৫৭ পয়সা।

এছাড়া ফার্নেস অয়েলচালিত অ্যাক্রোন ইউনিট-১-এর সক্ষমতার ব্যবহার হয় ২৫ শতাংশ। বাকি দুই কেন্দ্রে সক্ষমতার অর্ধেকের কিছু বেশি ব্যবহার হয়। সব মিলিয়ে গত অর্থবছর বাংলাক্যাট ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে এক হাজার ১২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।