আতাউর রহমান: ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে ‘বাংলা বন্ড’ ছাড়ার পর এবার দেশে ‘টাকা বন্ড’ ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। বন্ড ছেড়ে টাকা তুলে দেশের বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগের লক্ষ্য সংস্থাটির। এতে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে এই বন্ডের টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে আইএফসি। এতে পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন ঘটবে বলে আইএফসি মনে করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে আইএফসি ৪ বিলিয়ন ডলারের সাইজের টাকায় বন্ড ইস্যু করতে আবেদন করেছে বলে জানিয়েছে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
তবে আইএফসির বন্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে অফশোর ও অনশোর মুদ্রা রূপান্তরের অনুমতি, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কর দেয়া এবং মুদ্রার দর কমা-বাড়ার প্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষার সক্ষমতাসহ বেশ কয়েকটি আইনগত ও নীতিগত সমস্যা রয়েছে। এ কারণে সেসব সমস্যা সমাধানে এবং বৈদেশিক মুদ্রার অদলবদল ও হেজিং সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজনে একটি বৈঠকের প্রস্তাব করেছে আইএফসি।
সম্প্রতি এ বিষয়ে আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার বাংলাদেশের জন্য মার্টিন হোল্টম্যান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডি বিভাগ ও বিএসইসিকে অবহিত করা হয়েছে। আইএফসি থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর আইএফসির সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করার জন্য ধন্যবাদ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে বৈঠকে স্থানীয় মুদ্রায় বন্ড ইস্যু করার বিষয়ে মতামত বিনিময় হয়। আলোচনাটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং গঠনমূলক ছিল যার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছে আইএফসি।
আরও বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ১৭ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে আইএফসির যোগাযোগের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, প্রযোজ্য আইন, কর্তৃপক্ষের প্রবিধান, নিয়ম এবং সম্মতি সাপেক্ষে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পুঁজিবাজারে টাকায় অনশোর ডিনোমিনেটেড বন্ড ইস্যু করার জন্য আইএফসিকে নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। এর একটি অংশ প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির কথাও বলা হয়েছে।
তবে সেখানে আইএফসিকে অন-লেন্ডিংয়ের পাশাপাশি অফশোর ও অনশোর মুদ্রা রূপান্তরের অনুমতি দেয়া হয়নি এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কর দিতে বলা হয়েছিল। এদিকে এই বিধিনিষেধগুলোর কারণে আইএফসির মুদ্রার এক্সপোজার হেজ করার সক্ষমতা এবং স্থানীয় বাজারে অতিরিক্ত আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে উš§ুক্ত এক্সপোজারের কারণে ঋণ ঝুঁকি তৈরি হয়?।
এছাড়া চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সেই আলোচনার ওপর ভিত্তি করে, এটা প্রতীয়মান হয় যে, বৈদেশিক মুদ্রার অদলবদল এবং হেজিং সম্পর্কে আরও ভালো বোঝার প্রয়োজন এবং আইএফসি দ্বারা স্থানীয় মুদ্রা-নির্ধারিত বন্ড ইস্যু করার ক্ষেত্রে কর মওকুফের মতো বিষয়গুলোয় জোড় দিয়ে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে। তাই আলোচনার মাধ্যমে আইএফসি তাদের ট্রেজারি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একটি বৈঠকের প্রস্তাব করেছে, যারা কর্মশালায় উপস্থিতির জন্য বাংলাদেশ সফর করবেন। কারণ আইএফসি ট্রেজারি বিশেষজ্ঞদের স্থানীয় মুদ্রার অনশোর বন্ড ইস্যুতে ভালো অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তারা বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাজারের উন্নয়ন সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত।
আরও বলা হয়, এই প্রস্তাবটি যদি গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে, আইএফসি এগিয়ে যেতে চায় এবং একে অপরের সুবিধাজনক তারিখ ও সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈঠকের ব্যবস্থা করতে চায়। আইএফসি এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের জন্য দৃঢ় সমর্থনের প্রত্যাশা করছে, যা বিভিন্ন অগ্রাধিকার খাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রাপ্য বাড়াতে এবং দেশীয় পুঁজিবাজারের বিকাশে সহায়তা করবে।
এ বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলে তিনি দেখে কোনো উত্তর দেননি এবং ফোন করলে রিসিভ করেননি।
এদিকে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, এ বিষয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়। ফাইল দেখে এ বিষয়ে পরে জানানো যাবে বলে তিনি জানান।
প্রসঙ্গত, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) গত বছর ১৭ অক্টোবর আইএফসিকে এই টাকা বন্ড ছাড়ার প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। ইআরডি জানিয়েছে, আইএফসি টাকা বন্ড ছাড়লে তা ব্যবসা হিসেবেই গণ্য হবে। এ জন্য অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো যথাযথ কর দিতে হবে।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি অনুমোদন দিলে আইএফসির টাকা বন্ড চূড়ান্ত রূপ পাবে। সেজন্য এই দুটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে এখনও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি সফরকারী প্রতিনিধিদলটি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
আইএফসি এতদিন বিদেশ থেকে তহবিল এনে বেসরকারি খাতে অর্থায়ন ও বিনিয়োগ করে আসছিল। এখন দেশের অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যবসায় যুক্ত হতে চাইছে। এতে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ নিয়ে আইএফসির বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের ভারপ্রাপ্ত দেশীয় ব্যবস্থাপক নুঝহাত আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘টাকা বন্ড’ ছাড়ার উদ্যোগের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন না হওয়ায় এখনই এ নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি।
জানা গেছে, বন্ড ছেড়ে ঠিক কত টাকা তোলা হবে, তা আইএফসি এখনও ঠিক করেনি। টাকা তুলতে বিনিয়োগকারীদের কত কুপন রেট দেয়া হবে ও কত সুদে অর্থায়ন করবে, তা-ও ঠিক করা হয়নি। ২০১৯ সালের শেষের দিকে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে (এলএসই) প্রথমবারের মতো তালিকাভুক্ত হয় ‘বাংলা বন্ড’, যার মাধ্যমে ১ কোটি ৯৫ লাখ হাজার ডলার সংগ্রহ করা হয়, যা তখন বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬০ কোটি টাকার সমান ছিল। সব মিলিয়ে বাংলা বন্ডের মাধ্যমে আরও কয়েক ধাপে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনার কথা জানানো হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলা বন্ডের নামে আইএফসি প্রথমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সুদে ৯৫ লাখ ডলার ও পরে ৭ দশমিক ১০ শতাংশ সুদে ১ কোটি ডলার সংগ্রহ করে। ব্যাংক অব আমেরিকা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা এই বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বন্ডটির সুবিধা ছিল দেশীয় মুদ্রায় আসল ও সুদ পরিশোধ করা।