শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ভয়াবহতা!

মেহেদী হাসান বিপ্লব: আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎÑএ কথাটি তখনই অর্থবহ হবে যখন একটি শিশুকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠার যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সমাজে অসচেতনভাবে বা শিশুদের জন্য কতটুকু সঠিক সেসব বিষয়ে তেমন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কোমলমতি শিশুদের গড়ে তোলা হয়। শিশুদের ব্যাপারে পিতা-মাতার আচরণও থাকে উদাসীন; যা একটি শিশুর সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। আজকাল পিতা-মাতা শিশুদের আধুনিকতার নামে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কুপ্রভাব পড়ে এমন প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত করছে। মোবাইল ফোনের মধ্যে অন্যতম। ফলে অনেক শিশু এখন আর খেলাধুলা অভ্যস্ত না হয়ে বাড়িতে, বাগানে ও মাঠে-ঘাটে অর্থাৎ বিভিন্ন জায়গায় মোবাইলের মাধ্যমে গেম খেলাসহ নানা ধরনের আসক্তিমূলক সফটওয়্যার ব্যবহার করছে; যা শিশুদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি শিশু এক বেলা না খেয়ে থাকতে পারলেও মোবাইল ছাড়া এক দণ্ডও থাকতে পারে না। অধিকাংশ পিতা-মাতা তাদের শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্তি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা না করে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এটাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু মোবাইল ফোনে আসক্তি তাদের শিশুদের জন্য ভয়াবহ হুমকিতে পরিণত হতে পারে, তা তারা উপলব্ধি করতে পারে না বা করে না।

লিডস বেকেট ইউনিভার্সিটির গবেষকদের একটি নতুন গবেষণায় ১১-১৮ বছর বয়সী ৫৯৪ জন শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোন ব্যবহার পরীক্ষা করা হয়েছে। বেশিরভাগই বলেছে, তারা পারিবারিক খাবারের সময়, বাড়ির কাজ করার সময় এবং এমনকি স্কুলের পাঠের সময় নিয়মিত তাদের ফোন চেক করে। যেখানে ৯৬ শতাংশ বলেছে, তারা প্রতি দুই মিনিটে তাদের ফোন চেক করেছে, ৮৫ শতাংশ বলেছে যে তারা দিনে চার থেকে ছয় ঘণ্টা অনলাইনে কাটায়। দুই তৃতীয়াংশ বলেছে যে তারা মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তির কারণে রাতে দুই থেকে চার ঘণ্টা ঘুমাতে পারে।

প্রায় সবাই (৯৮ শতাংশ) বলেছে, তাদের ফোন বন্ধ করা হলে তারা সামলাতে লড়াই করবে। কেউ কেউ স্বীকার করেছে যে তাদের ফোন ছাড়া থাকা তাদের চরম উদ্বেগের কারণ হতে পারে এবং এমনকি শারীরিক সংঘর্ষের দিকেও যেতে পারে।

আজকের শিশুরা এমন একটি রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি পরিবেশে বেড়ে উঠছে, যা মানব ইতিহাসে আগে কখনও ছিল না। মোবাইল ফোন এবং মোবাইল ফোন মাস্ট দ্বারা নির্গত বিকিরণ শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আমাদের শরীরে সেলফোন বিকিরণের প্রভাব সম্পর্কে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একটি সমীক্ষা বিতর্ককে আলোড়িত করেছিল, যখন এটি মোবাইল ফোনের মস্তিষ্কের কার্যকলাপে প্রভাব ফেলতে পারে তা তদন্ত করে। মোবাইল ফোনের কারণে শিশুদের কী কী স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকতে পারেÑএই বিষয়ে ডাক্তারি পর্যালোচনা করেছেন ডা. নেহা ভাভে সালঙ্কার, (যিনি ভারতের নাগপুরের  ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের একজন পরামর্শক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) এবং মিসেস দীপল মেহতা, (যিনি ভারতের মুম্বাইয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, পিজি ডিপ্লোমা ইন গাইডেন্স অ্যান্ড কাউন্সেলিংয়ের মনোবিজ্ঞানী)।

তারা শিশুদের ওপর মোবাইল ফোনের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে বলেন : মোবাইল ফোনে আসক্তির কারণে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রোগ বা সমস্যা হতে পারে । যেমন :

(ক) নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার: গবেষণায় দেখা গেছে, যে শিশুরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্ক ও কানে নন-ম্যালিগন্যান্ট টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

(খ) ক্যানসার: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) সেলফোন বিকিরণকে ‘মানুষের জন্য সম্ভবত কার্সিনোজেনিক’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় ৬০ শতাংশের বেশি বিকিরণ মস্তিষ্কে শোষণ করে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে তাদের মস্তিষ্কের পাতলা ত্বক, টিস্যু এবং হাড়গুলো তাদের প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় দ্বিগুণ বিকিরণ শোষণের জন্য আরও দুর্বল করে তুলতে পারে; যা হোক, অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। তাদের উন্নয়নশীল স্নাযুতন্ত্র তাদের এই ‘কার্সিনোজেন’-এর জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। মোবাইল থেকে রেডিও তরঙ্গ শুধু কানের আশপাশে নয়, মস্তিষ্কের গভীরে প্রবেশ করে। বিঘ্নিত মস্তিষ্কের কার্যকলাপ শিশুদের শেখার ক্ষমতা এবং অন্যান্য আচরণগত সমস্যাকে ব্যাহত করতে পারে। এমনকি এটি তাদের মেজাজ এবং ক্লাসরুমে শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, যদি তারা বিরতির সময় ফোন ব্যবহার করে থাকে। কিশোরদের মতো শিশুরাও মোবাইল ফোনে আসক্ত। তারা সব সময় তাদের মোবাইল ফোনে গেম খেলে, চ্যাট করে এবং তাদের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে। স্কুল সরবরাহের পাশাপাশি, অনেক শিক্ষার্থী তাদের স্কুলে, তাদের প্রতিদিনের ভ্রমণে তাদের মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। তারা তাদের অবসর সময়ে ফোনে কথা বলে এবং ক্লাস চলাকালীন বার্তা পাঠায়। এভাবে তারা শেখানো পংাঠটি মিস করে এবং অন্যান্য শিক্ষার্থীদের থেকে পিছিয়ে পড়ে।

অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরীক্ষার সময় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় অনিয়ম ও প্রতারণার শিকার হয়। কেউ কেউ ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে আবার কেউ কেউ এতে তথ্য সঞ্চয় করে। কেউ কেউ পরীক্ষার হলে তাদের কাছে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর পাঠাতেও এটি ব্যবহার করে। এটা ধরা পডলে ছাত্রের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে পারে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, স্মার্টফোনের অত্যধিক ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাডায়। মোবাইল ফোনের বর্ধিত ব্যবহার শিশুদের দৃষ্টি সমস্যা সৃষ্টি করে। ৩০ জন মেডিকেল ছাত্রদের ওপর পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, তাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ সেলফোন ভিশন সিন্ড্রোম পাওয়া গেছে। লক্ষণগুলোর মধ্যে চাপ, লালভাব, জ্বলন্ত সংবেদন, ঝাপসা দৃষ্টি এবং শুষ্ক চোখ অন্তর্ভুক্ত। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্তানদের স্মার্টফোন দেয়ার অর্থ হলো, তাদের হাতে এক বোতল মদ কিংবা এক গ্রাম কোকেন তুলে দেয়া। কারণ স্মার্টফোনের আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক। ২ মিনিট স্থায়ী একটি মোবাইল কল শিশুদের মস্তিষ্কের হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে, যা কিনা পরবর্তী এক ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের মস্তিষ্কে বিরাজ করে। হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা বেড়ে যায় দ্বিগুণ, ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রক্তের চাপ বেড়ে যায়, দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে এমনকি নিয়মিত ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়। স্ক্রিনের রেডিয়েশন প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, শিশুদের জন্য তা আরও বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর, যা কিনা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে। সারা পৃথিবীতে এখন শিশুরা প্রায় বেশিরভাগ সময়েই মোবাইল ফোন নিয়ে খেলা করে। এ প্রসঙ্গে সানি’স স্কুল অব পাবলিক হেলথের ডিন ডেভিড কার্পেন্টার বলেছেন, ‘শিগগিরই আমরা হয়তো একটি মহামারি রোগের শিকার হতে পারি এবং সেটি হবে মস্তিষ্কের ক্যানসার।’ গবেষণা থেকে আরও বেরিয়ে এসেছে যে মোবাইল ফোন ব্যবহার শিশুদের শ্রবণক্ষমতাও হ্রাস করে দেয়।

রেডিয়েশন গবেষক কেরি ক্রফটন বলেছেন, ‘তবে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই এখন ১৮ বছরের কম বয়সীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, যা কিনা অন্যদের জন্য একটি ভালো নিদর্শন।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিভাগের প্রধান সাঈদা আনোয়ার বলেন, মোবাইলের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করছে। ফলে তৈরি হয় শিশুদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। তা ছাড়া প্রযুক্তির এ আসক্তির ফলে শিশুদের আবার দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হচ্ছে; ফলে শিশুর স্থূলতাও বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে শিশুর চোখের সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। শিশুদের পারিবারিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

সুতরাং আমরা যদি শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক না থাকি তাহলে আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ না হয়ে আগামী দিনের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য শিশুদের মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। কোনোভাবেই শিশুদের মোবাইল ফোনে আসক্ত হতে দেওয়া যাবে না। তাদের নিকট মোবাইল ফোন ব্যবহার সীমিত করতে হবে। প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া উচিত, এতে তাদের মন প্রফুল্ল থাকবে এবং নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হবে। ফলে তাদের মেধা বিকশিত হবে। সর্বোপরি শিশুদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে এবং পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তবেই একটি শিশু সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার মতো যোগ্য হয়ে গড়ে উঠবে।

শিক্ষার্থী

দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়