সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংক!

ইসমাইল আলী রোহান রাজিব: বাজেট বাস্তবায়নে চাহিদা মেটাতে দুই উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে সরকার। প্রথমত, সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও দ্বিতীয়ত, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া। তবে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকঋণের ওপরই বেশি নির্ভর করছে সরকার। এক্ষেত্রে প্রধান উৎসই ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংক। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এ চিত্র বদলে গেছে। সরকারের ঋণ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী। বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিবর্তে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় ২২ হাজার ৮৬২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিবর্তে উল্টো পরিশোধ করা হয়েছে চার হাজার ৫৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ চার মাসে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে ১৮ হাজার ৩২২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

এদিকে চলতি অর্থবছর প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৮৩৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। ওই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিবর্তে উল্টো পরিশোধ করা হয়েছে চার হাজার ৩০৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে সরকারের ব্যাংকঋণ ছিল ১২ হাজার ৫২৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ হিসাবে অক্টোবরে সরকারের ব্যাংকঋণ বেড়েছে পাঁচ হাজার ৭৯৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

যদিও অক্টোবরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ছয় হাজার ২৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এ সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ২৩২ কোটি দুই লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি করে নিজেই কিনছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে। তবে নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যম হওয়ায় এক সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দেয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকত। তবে গত অর্থবছর থেকে এ চিত্র পরিবর্তন হতে শুরু করে।

কয়েকজন ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ সুদহারের চেয়ে ট্রেজারি বিলের সুদহার কম হওয়ায় বাণ্যিজিক ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ড কেনায় আগ্রহ হারাচ্ছে। তাই সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ না বেড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাড়ছে। এছাড়া সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাড়ানোর এ নীতি অনুসরণ করছে; মূলত বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে। তবে এ নীতির ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৮ হাজার ৫০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ৭২৯ কোটি আট লাখ টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ দুই লাখ ৯ হাজার ৭৭৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

এদিকে গত অর্থবছরের জুনশেষে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৫৫ হাজার ৮৬৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৩১৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, সরকারের ঋণ নেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী বজায় থাকলে মূল্যস্ফীতির ওপর একটা চাপ তৈরি হবে। তবে তিন-চার মাসের তথ্য বিবেচনা করে বলা যাচ্ছে না আসলে এটা দীর্ঘমেয়াদি কি না। এটা সাময়িক হলে সমস্যা হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদি হলে তা সমস্যা তৈরি করবে।

তিনি আরও বলেন, ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। আবার সরকার ট্রেজারি বিল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করলে তা বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াবে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থা। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাবাজার এখন সংকটে রয়েছে। এ দুটো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বেশি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৯ হাজার ৮৩৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আর ওই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া

হয়েছিল ১০ হাজার ৫০৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ওই অর্থবছর সরকারের ব্যাংকঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৮০০ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

পরের (২০১৯-২০) অর্থবছর সরকারের ব্যাংকঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। সে অর্থবছর মোট ৭০ হাজার ৭১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল মাত্র ছয় হাজার ৫৯২ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছিল ৬৪ হাজার ১২২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছর সরকারের ব্যাংকঋণের পরিমাণ হঠাৎ কমে যায়। সে অর্থবছর সরকার নিট ঋণ নেয় ২৬ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। ওই অর্থবছর বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছিল ৫৩ হাজার ৯৭৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিবর্তে ২৭ হাজার ৬৬৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধ করে সরকার।

এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর সরকারের ব্যাংকঋণের পরিমাণ আবার বেড়ে যায়। সে অর্থবছর মোট ৭২ হাজার ৭৪৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা ঋণ নেয় সরকার। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছিল ৪১ হাজার ৩৪৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। মূলত গত অর্থবছর থেকেই সরকার ব্যাংকঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী হওয়া শুরু করে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সবসময় ব্যাংক তার বিনিয়োগের একটা অংশ রাখতে চায় সরকারের বিভিন্ন ট্রেজারি বিল-বন্ডে। এটা একটা ঝুঁকিমুক্ত পোর্টফোলিও। এটা মার্কেট রেটের কারণে কখনও ভালো আবার কখনও খারাপ হয়ে থাকে। তবে বিষয়টি নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছের ওপর। কারণ সরকার যাদের কাছে এ বিল-বন্ড বিক্রি সুবিধাজনক মনে করে তাদের কাছেই বিক্রি করে।