স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে

কাজী সালমা সুলতানা: ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পালাতে থাকে। সর্বত্র পাকবাহিনীকে পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকে সম্মিলিত বাহিনী। আকাশে মিত্রবাহিনী অবাধ গতিতে উপর থেকে বিমান আক্রমণ চালায়। বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী সৃষ্টি করে নৌ অবোরোধ। পাকসেনারা দিশেহারা এবং একপেশে হয়ে পড়ে। প্রতিঘণ্টায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর অগ্রগতি হয় অপ্রতিরোধ্য।

এদিন দিবাগত রাতে যশোরে প্রায় অবরুদ্ধ পাক সেনাবাহিনীকে ভারতীয় বাহিনী আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। যশোর তখন ঢাকা ও খুলনা থেকে বিচ্ছিন্ন। পাকবাহিনী যশোর থেকে খুলনায় সরে যেতে থাকে। মাঝরাতে সম্মিলিত বাহিনী আঘাত হানে ঝিনাইদহের উত্তরে ও পশ্চিমে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর। এছাড়া ঝিকরগাছাতেও আক্রমণ চলে।

কুড়িগ্রাম, ফেনী, ঝিনাইদহ, সুনামগঞ্জ ও লালমনিরহাট জেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। চূড়ান্ত বিজয়ের ১০ দিন আগেই যৌথবাহিনীর দুর্দমনীয় বীরত্বে মুক্তির স্বাদ পান এসব জেলার মানুষ। এছাড়া লালমনিরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ, বোচাগঞ্জ, বিরামপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলাও পাকিস্তানি শত্রু মুক্ত হয়।

এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তার এই স্বীকৃতি দেয়ায় পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় উপনির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে। এ নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

মিত্রবাহিনীর বিমানের বোমাবর্ষণে ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এদিন ভোর থেকেই পাক নবম ডিভিশনের পলায়ন পর্ব শুরু হয়ে যায়। যশোর-ঢাকা সড়কে ভারতীয় বাহিনী ঘাঁটি করায় বাধ্য হয়ে পাক নবম ডিভিশনের একটি অংশ মাগুরা হয়ে মধুমতি নদী ডিঙিয়ে ঢাকার পথে পালায়। আরেকটি অংশ কুষ্টিয়ার দিকে পালায়।

৬ ডিসেম্বর বিকালের মধ্যেই যশোর সেনানিবাস খালি করে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। এদিন বিকালে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল বারাতের নেতৃত্বে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে নেয়। যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে হানাদারদের পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তির আনন্দে উল্লসিত যশোরের মানুষ নেমে পড়ে রাজপথে। যশোরের আকাশে ওড়ে বাংলার লাল-সবুজ পতাকা। পাকিস্তানি বাহিনী পালানোর পথে সব কয়টা রাস্তার ওপরের ব্রিজগুলো ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে।

এদিন নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি-সংক্রান্ত মার্কিন প্রস্তাবের ওপর সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় দফা ভেটো দেয়। সোভিয়েত সরকারের একজন মুখপাত্র মস্কোয় বলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন উদাসীন থাকতে পারে না। কারণ, এখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিরাপত্তার স্বার্থ জড়িত আছে।

এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সময় প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। তিনি আরও বলেন, আমাদের বাহিনী বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান ধরে রাখতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। লে. নিয়াজি রাতে ঝিনাইদহ অবস্থান থেকে সরে এসে তার বাহিনীকে ঢাকা রক্ষার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ঢাকার পথে পেছনে এসে মেঘনার তীরে সৈন্য সমাবেশ করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু তা আর তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ ততক্ষণে ঢাকা-যশোর সড়ক মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

এদিকে মধুমতি অতিক্রম করে মিত্রবাহিনীর একটি দল খুলনার দিকে এবং অন্য একটি দল কুষ্টিয়ার দিকে অভিযান অব্যাহত রাখে। এদিন ভারতের স্বীকৃতি পেয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মিত্ররাষ্ট্র ভারতের জওয়ানদের অভিনন্দন জানান। উড়তে থাকে বাংলাদেশের বিজয় পতাকা।

এদিকে পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রণাঙ্গন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে। এদিন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী মুক্ত করে। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে বীরগঞ্জ ও খানসামার পাকিস্তান ঘাঁটির দিকে এগিয়ে চলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। লাকসাম, আখাউড়া, চৌদ্দগ্রাম, হিলিতে মুক্তিবাহিনী দৃঢ় অবস্থান নেয়। রাতে আখাউড়া ও সিলেটের শমসেরনগর ও ঝিনাইদহ যৌথবাহিনীর অধিকারে আসে।

তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ’৭১-এর দশ মাস ও মূলধারা ৭১