সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: ড্রেজার ব্যবসার মাধ্যমে ব্যবসায় আসেন মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী। এরপর ড্রেজার নির্মাণ, বার্জ, জাহাজ নির্মাণ খাতায় নাম লেখান। পাশাপাশি এগ্রো, পেইন্টসহ নানা ব্যবসা ও বাণিজ্য গড়ে তুলেন। গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায় তেমন সাফল্য নেই। উল্টো তিনি ২০১৯ সাল থেকে এফএমসি স্পোর্টস ক্লাব দুবাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক টি-টেন ক্রিকেট লিগ ‘আবুধাবি টি-১০’ লিগে ‘বাংলা টাইগার্স’ নামে ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম পরিচালনা করছে। অর্থাৎ দেশে ব্যবসার চেয়েও বিদেশে খেলায় মনোযোগী তিনি।
জানা যায়, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদণ্ডীতে কর্ণফুলী নদীতীরঘেঁষে প্রায় ৬৫ একর জমির আয়তনে এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের কার্যক্রম চলছে। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড অত্যাধুনিক এলটিসি ভেসেল, টিসিভি ভেসেল, মাল্টিপারপাস ভেসেল, ব্যারাক বার্জ, সার্ভে ভেসেল, কনটেইনার শিপ, অয়েল ট্যাংকার, যাত্রীবাহী জাহাজ, ফিশিং ট্রলার, ড্রেজার ইত্যাদি নির্মাণ করছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির গত এক বছর ধরে নৌবাণিজ্য অধিদপ্তরের অনাপত্তি সনদ ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করছে; যা জেনে নীরবে বসে আছে নৌবাণিজ্য দপ্তর। আর প্রতিষ্ঠানটির একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়মিত বেতন ও ভাড়া না পাওয়ায় চাকরি ছেড়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়।
নৌবাণিজ্য দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে জাহাজ শিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। জাহাজ নির্মাণ শিল্প খাতে ১৩টি শিপইয়ার্ডে অনুমোদন আছে। এসব শিপইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালনায় নৌবাণিজ্য দপ্তরের অনাপত্তি সনদ নেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড এবং খান ব্রাদার্স শিপবিল্ডার্স লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের অনাপত্তি সনদ নেই।
অপরদিকে নৌবাণিজ্য দপ্তরের অনাপত্তি সনদ আছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড, আমান শিপইয়ার্ড, টগি শিপিং অ্যান্ড লজিস্টিকস লিমিটেড, সি রিসোর্স শিপইয়ার্ড লিমিটেড, রেডিয়েন্ট শিপইয়ার্ড লিমিটেড, আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড শ্লিপওয়েস লিমিটেড, মেঘনা শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড, ভাই ভাই মেরিন শিপবিল্ডার্স লিমিটেড, চট্টগ্রাম ফিশারিজ হারবার, বে টেক শিপবিল্ডার্স এবং ডেল্টা শিপইয়ার্ড লিমিটেড।
নৌবাণিজ্য দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, অনাপত্তি সনদ ছাড়া কোনো শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হলে তা আইনগতভাবে অবৈধ কার্যক্রম হিসেবে বিবেচিত হবে। কার্যক্রম পরিচালনায় অবশ্যই হালনাগাদ অনাপত্তি সনদ লাগবে। তবে আমাদের আইনে জরিমানার বিষয় না থাকায় সংশ্লিষ্টরা সুযোগ নিচ্ছে। আমরা নতুন একটি সার্কুলার জরিমানার বিধান রেখে পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। তখন এসব বিষয় যুক্ত হবে।
এফএমসি ডকইয়ার্ডে কর্মরত ও ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প ভয়াবহ রকমের সংকটে আছে। ২০২০ সালের করোনা ও বর্তমানে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ খাতে স্থবিরতা চলছে। আমাদের ডকইয়ার্ডে আগের মতো তেমন কাজ নেই; যা কাজ আছে তাও গতিশীল না। মূলধন সংকটে আছে। এছাড়া এফএমসি গ্রুপের অন্যান্য ব্যবসায় স্থবিরতা চলছে। এর মধ্যে এফএমসি পেইন্ট অ্যান্ড কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডও বন্ধ হয়ে আছে। এ কোম্পানিও নাকি বিক্রয়ের জন্য চেষ্টা চলছে। বিপুল পরিমাণে ঋণের বোঝা বয়ে এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? এছাড়া এফএমসি স্পোর্টস ক্লাব দুবাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক টি-টেন ক্রিকেট লিগ ‘আবুধাবি টি-১০’ লিগে মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরীর মালিকানাধীন বাংলাদেশের একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি টিম ‘বাংলা টাইগার্স’। এ খেলায় ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছর অংশগ্রহণ করে আসছে। আসলে তার মনোযোগ দেশের ব্যবসায় নেই।
অপরদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড সূত্র জানায়, জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সাল শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা; যা ২০২০ সালে ছিল এক হাজার ২১৭ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে এক হাজার ৩০ কোটি এবং ৮৯৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছর ব্যবধানে ঋণ বাড়ল ৫৭৯ কোটি টাকা। অথচ মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা বাড়েনি। বরং সংকোচিত হয়েছে।
এ বিষয়ে সদ্য বিদায়ী নৌবাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার মো. গিয়াস উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, অনেকগুলো শিপবিল্ডিং প্রতিষ্ঠান আমাদের অনাপত্তি সনদ ছাড়া বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিষয়টি আমাদের নজরে আসছে। আমরা তাদের অনাপত্তি সনদ নবায়ন করার জন্য বলেছি। কিন্তু তারা এখনও নবায়ন করেনি; যা পুরোপুরি আইনে লঙ্ঘন। আর আইনে শাস্তির বিধান না থাকায় আমরা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছি না। এ বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের চিঠি দিয়েছি। এছাড়া আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারছি না। এ ধরনের অভিযান পরিচালনায় আমাদের ঢাকা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আনতে হয়।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, একসময়ে জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ মেরামত করে বছরের ৭০ কোটি টাকা মুনাফা হতো। কিন্তু উচ্চাভিলাষী চিন্তার কারণে বেড়েছে ঋণ। কিন্তু বাড়েনি ব্যবসার আকার। আর গত চার বছর ধরে এফএমসি স্পোর্টস ক্লাব দুবাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক টি-টেন ক্রিকেট লিগ ‘আবুধাবি টি-১০’ লিগে ‘বাংলা টাইগার্স’ নামে অংশগ্রহণ করছে। গত নভেম্বর মাসে এ খেলায় এফএমসির দল অংশগ্রহণ করেছে। অথচ অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী ১২-১৫ মাস বেতন বকেয়া। এর মধ্যে বেশ কিছু জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প থেমে আছে। সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী অয়েল ট্যাংকার সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারেনি। আরেকজন এমপিরও অয়েল ট্যাংকার সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারেনি। এগুলো নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে। এদিকে ব্যাংকের ঋণের পাহাড় হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এয়াছিন চৌধুরীর ব্যবহƒত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।