শেয়ার বিজ ডেস্ক: ভাষা আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে যে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতার সেসব অবদান ও ত্যাগ ইতিহাস থেকে মুছে ফেলারও চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারও নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, তার আবার কী অবদান ছিল? তিনি তো জেলেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে তার কোনো অবদান নেই? তাহলে তিনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি।’
গতকাল সোমবার ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এবারের একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতার অবদান নিয়ে কথা বলেন তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সূত্র: বাসস।
এ অনুষ্ঠানে ১৯ ব্যক্তি বা তাদের প্রতিনিধি এবং দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একুশে পদক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। পদকপ্রাপ্ত সবাইকে তিনি আন্তরিক অভিনন্দন জানান।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।
পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা উল্লেখ আছে বলে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পরে আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধজন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে, আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি। গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ মিলে এমআর আখতার মুকুলের কাছে যাই। মুকুল ভাইকে বললাম, আপনার কাছে এই যে সমস্ত রিপোর্ট দিলাম, কোন তারিখে কখন কী করেছেন, এখানে সব বিস্তারিত আছে। ফাইলটা দিলাম, আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন।’
পরে তা নিয়ে নিয়ে ১৪ খণ্ডের বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেখা গেল আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান, যে সেøাগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই জয় বাংলা সেøাগান নিষিদ্ধ। ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সমস্ত নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñরেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যা কিছু ছিল তা-ই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, এখনকার প্রজš§ যার অনেক কিছু জানেও না।’
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রচেষ্টা, এমনকি রবীন্দ্র সংগীতও অন্যদের দিয়ে লেখানোর প্রচেষ্টা বাঙালি দেখেছে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভাষা ও সাহিত্যের ওপর বারবার এমন আঘাত আর কোনো দেশে এসেছে বলে তিনি জানেন না।
বঙ্গবন্ধু মাত্র তিন বছর সাত মাস ক্ষমতায় ছিলেনÑসে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই অল্প সময়ের মধ্যেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে তিনি জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ লাভ বাংলাদেশকে একটা উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের সেই মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। এর ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করলে দেশের স্তিমিত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা গতি লাভ করে এবং বিগত তিন মেয়াদে টানা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। কাজেই এ দেশকে এখন আর কেউ পেছনে টানতে পারবে না।’
একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি সালাম ও রফিক এবং ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা’ নামের সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘শহিদের রক্ত কখনও বৃথা যায় না, বৃথা যায়নি। যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের সেই অবদান আমরা সবসময় স্মরণ করি।’
একুশে পদকপ্রাপ্ত সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক গুণীজন রয়েছেন, যাদের অনেকের নামটি পর্যন্ত জানা নেই। এই পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তাদের অবদানকেই সবার সামনে নিয়ে আসায় তার সরকারের প্রচেষ্টা। এজন্য সম্মাননাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে।’
পদক পেলেন ১৯ ব্যক্তি, সমাজসেবা ও শিক্ষায় দুই প্রতিষ্ঠান, চলতি বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটেগরিতে তিনজন, মুক্তিযুদ্ধে একজন, শিল্পকলায় আটজন (অভিনয়, সংগীত, আবৃত্তি, চারু ও চিত্রকলা), রাজনীতিতে দুজন, শিক্ষায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতা, গবেষণা এবং ভাষা ও সাহিত্যে প্রত্যেকটিতে একজন করে একুশে পদক পেয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন ক্যাটেগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শামসুল হক (মরণোত্তর) ও হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান; অভিনয় ক্যাটেগরিতে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সংগীত বিভাগে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলা বিভাগে কনক চাঁপা চাকমা এ পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আব্দুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর), রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাটেগরিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার পেয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে ‘একুশে পদক’ প্রবর্তন করা হয়। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেক বিজয়ীকে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ ও নগদ অর্থ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদের সভাপতিত্বে ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।