রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর ও ভবিষ্যৎ গতিপথ

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : দেখতে দেখতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর হয়ে গেছে। গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি  রাতে ভোরের আলো ফোটার আগে পশ্চিমাদের শঙ্কা সত্যি করে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এতে  বিশ্ব নতুন এক ভোরের সম্মুখীন হয়। পাল্টে যায় বিশ্বরাজনীতির দৃশ্যপট। পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে  বিশ্বরাজনীতিতে আলোচনা ও সমালোচনার জš§ দেয় রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের বিষয়টি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর হওয়ার পরও যুদ্ধ সমাধানের কোনো উদ্যোগ তৈরি হয়নি দুদেশ থেকেই। যার ফলে আলোর মুখ দেখেনি ফলপ্রসূ আলোচনা।

যেকোনো যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব থাকে চোখে পড়ার মতো। যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে  থেকে।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর কয়েকটি কারণ পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথমত. রাশিয়া মনে করে ইউক্রেন হচ্ছে প্রাচীন রুশ অঞ্চল, যা তাদেরই অংশ। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে।

কিন্তু ইউক্রেন হচ্ছে পশ্চিমা ইউরোপ দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট দেশ। ২০১৪ সালে রুশপন্থি ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পদত্যাগ করার পর ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসেন ভলোদেমির জেলেনস্কি। যিনি পুরোপুরি পশ্চিমামুখী ও রুশ বিদ্বেষী। ইউক্রেন কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করবে; যা ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বেগবান করবে। কিন্তু পুতিন বা মস্কো প্রথম থেকে ঘোর আপত্তি জানিয়ে আসছে এই বিষয়ে। ভলোদেমির পুতিনের মূল দাবি হলো, পশ্চিমা দেশগুলোকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না। পুতিন আরও মনে করে, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদান করা রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানা। আর রাশিয়ার  অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানবে তা কখনও বরদাশত করবে না বলে হুশিয়ার দিয়ে আসছে মস্কো। তাছাড়া ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। যুদ্ধ বন্ধে ২০১৫ সালে বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে; যা আন্তর্জাতিক মিনস্ক শান্তি চুক্তি নামে পরিচিত। কিন্তু তাতেও লডাই  থামেনি। আর এ কারণেই রাশিয়ার নেতা বলছেন, ওই অঞ্চলে তিনি তথাকথিত শান্তি রক্ষী পাঠাচ্ছেন। আর এসবের দরুন চূড়ান্ত সূত্রপাত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যে যুদ্ধ পাল্টে দিয়েছে বিশ্বব্যবস্থার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি।

বিশ্লেষকদের মতে, একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হতে যাচ্ছে রাশিয়া ও  ইউক্রেন যুদ্ধ। তা এই এক বছরে ভালোভাবে আঁচ করতে পেরেছে বিশ্ববাসী। রাশিয়া ও  ইউক্রেনের মধ্যকার এই যুদ্ধ সংঘটিত হলেও প্রকৃত পক্ষে এই যুদ্ধের রেশ, আবহ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বব্যাপী। এই এক বছরে পুরো বিশ্বের খোলনলচে বদলে গেছে অনেকখানি। উন্নয়নশীল, মধ্যমশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ওপর এই যুদ্ধের বিশাল প্রভাব পড়েছে। রাশিয়া হচ্ছে জ্বালানি তেল ও শস্যতে সমৃদ্ধ একটি দেশ। অন্যদিকে ইউক্রেন ও শস্য আমদানি, রপ্তানিতে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিশ্বজুড়ে গম সরবরাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের জোগান দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন। সয়াবিনের ৮০ শতাংশই সরবরাহ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। পুরো বিশ্বের মোট গমের ৩০ ভাগই উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। ১০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ইউক্রেনে। সূর্যমুখী তেলের ৬৫ শতাংশ উৎপাদিত হয় রাশিয়ায়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাশিয়ার প্রভূত ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের ভূমিকা কম নয়। ফলে  এই যুদ্ধের কারণে গত এক বছরে বিশ্ববাসী সম্মুখীন হয় বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও কৃষি সংকটে।

যুদ্ধ শুরুর দুদিন পর অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দেয়। রাশিয়াও পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর। এমনকি বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন খেলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে রাশিয়াকে বের করে দেয়া হয়। তবে জ্বালানি তেলের তেলস্ফীতির পূর্ণ ফায়দা আদায় করে নেয় রাশিয়া এই এক বছরে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেলে ভরপুর দেশ রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি তেল রপ্তানি করে আসছে। পশ্চিমারা রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু যুদ্ধের ফলে ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার কাছ জ্বালানি তেল সরবরাহ করা কমিয়ে দেয়। তারা উচ্চমূল্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জ্বালানি তেল কিনতে বাধ্য হয়। ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায় আকাশচুম্বী। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্বে খাদ্যের  দাম বৃদ্ধি পায় ৩০ শতাংশ। তাছাড়া এই যুদ্ধের ফলে গত এক বছরে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ধরন, ধারণেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানির সামরিক, আর্থিক ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর দ্বারা এই যুদ্ধে এখনও ভালোভাবে টিকে রয়েছে ইউক্রেন। অপর দিকে রাশিয়া পুরোপুরি যুদ্ধের লাগাম ধরে রাখতে চাইছে নিজেদের মধ্যে। এতে দুই দেশের পাল্টাপাল্টি অস্ত্রের সরগরমে চলমান রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তি নির্ভর দেশগুলো বা বিশ্বরাজনীতির মোড়ল দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনকে। পাশাপাশি এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সহায়তা করে আসছে বাইডেন প্রশাসন। অন্যদিকে চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরানের সমর্থন রয়েছে রাশিয়ার প্রতি। বলতে গেলে পশ্চিমাদের সঙ্গে একাই লড়াই করে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। পাশাপাশি আরেক পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ ভারত কম মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে মস্কো থেকে। এতে করে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও সুদূঢ় হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের স্নায়ুযুদ্ধ চলমান রয়েছে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে ট্রাম্পের সময়কাল থেকে। উপরন্তু বর্তমান সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক সুবিধাজনক নয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চীনকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক করেছে আরও মজবুত। এমনকি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে চীন কোনো প্রকার মন্তব্য করেনি।

প্রথমদিকে চীন নিরপেক্ষ থাকলেও কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যে রাশিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে বেইজিং, যা নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে বিশ্বরাজনীতিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া চীন ও ভারত নিয়ে নতুন এক অক্ষশক্তি তৈরি হয়েছে বিশ্বরাজনীতিতে। যার উৎপত্তিস্থল হচ্ছে রুশ ইউক্রেন যুদ্ধ।

পরমাণু কর্মসূচিতে অগ্রসরমাণ আরব দেশ ইরানও রাশিয়ার আরও কাছাকাছি ও কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়ন করেছে গত এক বছরে। তাছাড়া এই এক বছরে বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি কার্যক্রম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ গতিপথ কী হবে, তা বলা দুষ্কর। তবে শিগগিরই যে এই যুদ্ধের কোনো সমাধান হবে না তা অনুমেয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক পাভেল লুজিন বলেন, ‘মূল দৃশ্যপট একই তীব্রতাবৃদ্ধি। রাশিয়ার প্রথমবারের গুরুতর প্রচেষ্টার পর এখন দ্বিতীয়বারের মতো হামলা চলবে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় রাশিয়া নতুন করে হামলার ক্ষেত্রে আরও ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে। রাশিয়ার যুদ্ধের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়নি। তারা ইউক্রেনকে ধ্বংস করে দিতে চায়। ফলে বিশ্ববাসীর ভোগান্তি, কূটনৈতিক দৃশ্যপটের বহুল পরিবর্তন ঘটবে আরো সামনে। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এখন অনেকটা প্রক্সি যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। কোনো দেশ খালি হাতে ময়দান থেকে ফিরতে চাইছে না। এ বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন পরস্পর বদ্ধপরিকর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরেকবার খালি হাতে যুদ্ধ থেকে ফিরতে চাইছে না বিধায় রাশিয়ার সামরিক অভিযান ও তৎপরতা সামনে আরও বৃদ্ধি পাবে; যা বিশ্ববাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে। এমনিক রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সরাসরি পারমাণবিক অস্ত্র হামলার হুমকি দিয়ে রেখেছে। জেলেনস্কিও  রাশিয়াকে হুংকার দিয়েছেÑলুহানস্ক, দোনেৎস্ক, খেরসনসহ দখলকৃত অঞ্চল উদ্ধার করবে। ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমানসহ আরও অস্ত্র চাইছে। এতে পরিষ্কার রাশিয়া-ইউক্রেন দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি মনোভাবে যুদ্ধের গতিপথ আরও ঘোলাটে হবে। তখন নব্য নৈমিত্তিক জটিল সমীকরণে উত্তপ্ততর হবে বিশ্বরাজনীতির ময়দান।

শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়