নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকঋণের সুদহারে পরিবর্তন আসছে। বিদ্যমান বেঁধে দেয়া সুদহার তুলে দিয়ে বাজারভিত্তিক করিডর প্রথা বিকাশ করার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কাজ করছে সংস্থাটি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র আয়োজনে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনের আন্তর্জাতিক বিজনেস সামিটে গতকাল রোববার দ্বিতীয় দিনের ‘লং টার্ম ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্লেনারি সেশনে এসব বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসিগত কাজ করছে। চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছি। একাধিক হারও বাদ দেব। বিনিময় হার হবে বাজারভিত্তিক ও এক। আমরা এর কাছাকাছি। শিগগির একটি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থা দেখতে পাবেন। আর সুদের হার নিয়েও কাজ শুরু করেছি। এরই মধ্যে আমানতের সুদের হারের ফ্লোর ও সিলিং প্রত্যাহার করেছি। বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণ করে করিডর প্রথা চালু করা হবে। শিগগির আমরা এ নতুন উদ্যোগ চালু করতে সক্ষম হব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকঋণ সুদের একটি অঙ্ক নির্ধারণ করে দেবে বাজারের বিদ্যমান পরিস্থিতি অনুযায়ী। তার সঙ্গে ঋণের
খাত অনুযায়ী সুদের একটি সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দেয়া হবে। সেখানে কত শতাংশ বেশি নিতে পারবে ব্যাংকগুলো, তা ঠিক করে দেয়া হবে।
খেলাপি ঋণ নিয়ে গভর্নর বলেন, আমাদের এখানে ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে। এতে দায় ও সম্পদের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। এজন্য খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঋণখেলাপি কমাতে আমরা উদ্যোক্তাদের ঋণের বদলে গ্যারান্টি দেব। আর উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলবে। ব্যাংক গ্যারান্টি থাকলে বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হবেন। অপরদিকে যারা টাকা নিচ্ছেন তাদের মধ্যে খেলাপির মনোভাব কমে আসবে। এ ছাড়া অর্থনীতির দিকগুলোকে শক্তিশালী করতে বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করার দিকে জোর দিয়ে রউফ বলেন, বন্ড মার্কেট শক্তিশালী করতে পারলে বাজারে বিনিয়োগের ধারা বৃদ্ধি পাবে।
অনুষ্ঠানে আব্দুর রউফ তালুকদার আরও বলেন, মূলধন জোগান দিতে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে নিয়মকানুনগুলো আরও পর্যালোচনা করতে হবে। শেয়ারবাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের নীতি সহায়তা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে এসএমই, কৃষি, পরিবেশবান্ধব খাতের জন্য তহবিল জোগান দিচ্ছে।
অধিবেশনে মূল প্রবন্ধে শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ এসেছে। এগুলো হলোÑলেনদেন ভারসাম্যে ঋণাত্মক অবস্থা, তিন মাসের আমদানি খরচের চেয়ে রিজার্ভ কমে যাওয়ার শঙ্কা, টাকার মান আরও দুর্বল হওয়া এবং বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
আরিফ খান বলেন, ২০৪০ সাল পর্যন্ত আমাদের যে বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, তাতে ১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থাকবে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ৯৯ শতাংশই ব্যাংক থেকে হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়েছে ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের মধ্যে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। সম্পদের মান খারাপ হয়ে পড়েছে। উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে বিকল্প মাধ্যম দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূলধন জোগানে বড় মাধ্যম হতে পারে শেয়ারবাজার।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশস (বিএসইসি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, একটি গতিময় ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তুলতে অনেক প্রকল্প নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আমরা সব খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পথে রয়েছি। কিছু কাজ হয়েছে, আরও কাজ হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো সুবিধা নিতে চাইলে বিএসইসি তাদের স্বাগত জানাবে।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেছেন, আমাদের পুঁজিবাজারে আরও অনেক অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রয়োজন। আমাদের এখানে যে পরিমাণ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বাড়লে আমাদের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন এবং বিনিয়োগ বাড়বে।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্কারের জন্য পরামর্শ দিয়ে আসিফ ইব্রাহিম বলেন, আমাদের তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য করহার যৌক্তিক করতে হবে। ছোট পুঁজির কোম্পানিগুলোর জন্য করহার যৌক্তিক করতে হবে। অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। তথ্য প্রকাশের প্রয়োজনীয়তার যৌক্তিকতা করতে হবে। আর প্রাইস ডিসকভার যৌক্তিক করতে হবে। এজন্য সরকারের উচিত অবকাঠামো উন্নয়নে পুঁজিবাজার থেকে অর্থায়ন করে বেসরকারি খাতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। এক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন, মালয়েশিয়া ও ভারত যেভাবে কাজ করে, তা অনুসরণ করা যেতে পারে।
সিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে এসএমই প্ল্যাটফর্ম ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড চালু করা হয়েছে। এ প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির শেয়ারের জন্যও ভালো। এটা আমাদের পুঁজিবাজারের একটা ভালো সংস্কার। সুকুকের মতো করপোরেট বন্ড এবং ইসলামিক বন্ডের লেনদেন সহজতর করার জন্য বন্ড মার্কেট প্ল্যাটফর্মও চালু করা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন প্রক্রিয়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন দ্বারা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে যোগ্য বিনিয়োগকারীর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, খেলাপি ঋণ হলো ক্যানসারের মতো। এটা স্বল্প সময়ে না কমলে মৃত্যু নিশ্চিত। খেলাপি ঋণের কারণে সবাই টাকা হারাচ্ছে। দেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারিত হলেও অনেকে মানছে না। এজন্য নির্দেশিত ঋণ হচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে খেলাপি হয়ে পড়ছে।
ব্রুমার অ্যান্ড পার্টনার্স বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালিদ কাদীর বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে যে অবস্থানে রয়েছে, এতে মিনি চায়না হিসেবে পরিচিত হতে পারে। কারণ এ দেশে সব ধরনের ব্যবসার উৎপাদন কার্যক্রম চালানো সম্ভব। এছাড়া আমাদের দেশে শুধু সস্তা কর্মী নয়, পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মীর চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা রয়েছে। কারণ অন্যান্য দেশে সস্তা কর্মী থাকলেও যথাযথ সংখ্যক কর্মীর প্রয়োজনীয়তা মেটানোর সক্ষমতা নেই। এটাই হলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম কারণ।
এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব উর রহমান বলেন, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ করলে তার ফিরে যাওয়া সহজ করতে হবে। এর সঙ্গে সুদহার, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারসহ নানা ঝুঁকি রয়েছে।
‘দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন’ শীর্ষক এ অধিবেশন সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান।