শত্রুতা থেকে সম্প্রীতির বন্ধনে সৌদি আরব ও ইরান

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান : বিশ্বরাজনীতি বাকি বিষয়বস্তুর তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বেশ জটিল। বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে শুধু বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি জড়িত থাকে না। এর সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা, বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। এর ফলে বিশ্বরাজনীতি হয়ে যায় বৈশ্বিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। আধুনিক এই বিশ্বে বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপট হচ্ছে ক্ষমতা ও অস্ত্রের ঝনঝনানি। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর পাশাপাশি উঠতি শক্তিধর দেশগুলোর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে গেছে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর। এর সঙ্গে কূটনৈতিক পরিকল্পনায় বেশ পরিবর্তন এসেছে আধুনিক সময়ে। কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার পাশাপাশি তারা বৈশ্বিক মানচিত্রে নিজেদের সমর্থনের পাল্লা ভারী করে। এতে ওইসব দেশের সামগ্রিক ক্ষমতা ও অর্থনীতির কাঠামো ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে ও উপসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী দুটি দেশ হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরান। সৌদি আরব হচ্ছে তেলসমৃদ্ধ দেশ। দেশটির জিডিপির ৪৫ শতাংশ আসে তেল থেকে । তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক বেশ শীতল এবং তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র ক্রয় করে সৌদি আরব। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলোর একটি হচ্ছে সৌদি আরব।

অন্যদিকে ইরান হচ্ছে বিগত কয়েক বছরে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে অগ্রসরমাণ একটি দেশ। ড্রোন প্রযুক্তিতে ইরানের সাফল্য বেশ নজরকাড়া। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। এর পরে দেশ দুটি একে অপরের সঙ্গে পাল্টপাল্টি হুমকিসহ মনোভাবে সরগরম রয়েছে।

সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে একসময় কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার সম্পর্কে অবনতির বেশ কারণ রয়েছে। শিয়া অধ্যুষিত দেশ হচ্ছে ইরান। আর সৌদি আরব হচ্ছে সুন্নি অধ্যুষিত দেশ। অর্থাৎ কৌশলগতভাবে ধর্মীয়ভাবে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে পার্থক্য প্রতীয়মান হয়। রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার বৈরী সম্পর্ক চলমান রয়েছে সাত বছর থেকে। ২০১৬ সালে সৌদি আরব শিয়া সৌদি ধর্মগুরু নিমর আল-নিমরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর জেরে তেহরানের সৌদি দূতাবাসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। তখন থেকেই দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেই থেকে দুই দেশের দূতাবাসও বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া ২০১৪ সালে ইয়েমেনের রাজধানী সানা দখল করে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা। এরপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার সৌদি আরবে নির্বাসিত হয়। ২০১৫ সালে ইয়েমেন সংঘাতে হস্তক্ষেপ করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট। এতে দুদেশের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। 

সৌদি আরব পশ্চিমাঘেঁষা হলেও তেহরান তার ঠিক উল্টো। তাছাড়া কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা তথা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি বিনিময় দুদেশের মধ্যে ছিল না। তাছাড়া দুই দেশের প্রধানের মধ্যে আশানুরূপ কোনো সমঝোতা হয়নি, যাতে দুই দেশের মধ্যে আবার সম্পর্ক জোড়া লাগবে এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনীতি স্থিতিশীল হবে। নিত্যনতুন পাল্টাপাল্টি হুংকারে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি। এর নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে পড়ে। এ অবস্থায় রিয়াদ ও তেহরানের সম্পর্ক আবার চালু করায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে চীন। মোদ্দা কথা, চীনই প্রধান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে। এর পাশাপাশি ইরাক, মিসর প্রভৃতি দেশ কয়েকবার দুই দেশের মধ্যে সমঝোতার জন্য আলোচনার চেষ্টা করলেও সেই আলোচনা আশার আলো দেখেনি। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু দেখেছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব।

বিশ্বরাজনীতির দামামায় চারদিকে শোনা যাচ্ছেÑকোন ক্ষমতাবলে চীন সৌদি আরব ও ইরানকে একত্রিত করেছে। মূলত চীনের সাহায্যে দুই দেশের সম্পর্ক জোড়া লাগে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বেইজিং সফর করেন। সেই সফরকে কেন্দ্র করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদিত হয়। পাশাপাশি গত ডিসেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন সৌদি আরব সফর করেন, তখন রিয়াদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নয়ন দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে দুই দেশের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে, যা সহজে অনুমেয়। তাছাড়া চীনের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা ইরানের জন্য সহজসাধ্য ছিল না, কারণ পশ্চিমা দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরান চীনের তৈরি পণ্য ও সমরাস্ত্র, বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। ইরানের পণ্য আমদানিতে চীন একচেটিয়া ভূমিকা নেয়ায় তেহরানের পক্ষে চীনকে না করা কঠিন ছিল। তাছাড়া করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সৌদি ও ইরানের কর্মকর্তারা অন্ধকার সে অধ্যায়টি আবার চালু করতে আগ্রহী হন। এর ফলে চীন প্রথমবারের মতো সরাসরি হস্তক্ষেপ করে সিকি শতাব্দীর ধরে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার চলা সংঘাত নিরসনে। গত ৫ এপ্রিল বিভেদ ভুলে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বৈঠকে বসলেন মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ ইরান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ ফয়সাল বিন ফারহানের মধ্যে এ বৈঠক হয়। ২০১৬ সালের পর প্রথমবার নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ। তেহরান বলেছে, চীনের মধ্যস্থতায় এক চুক্তির অধীনে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ প্রশস্ত হয়েছে।

মিডলইস্ট মিডিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট (মেমরি) ইরান-সৌদি চুক্তির যে সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে, তাতে বলা আছে, ইরানের পরমাণু কার্যক্রম ও আঞ্চলিক অস্থিরতা ঘটানো এবং সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়ার বিষয়টি আমলে নিতে হবে; দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের বিস্তার রোধকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নৌসীমা ও তেল স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইরানকে অঙ্গীকার করতে হবে।

চীনের ভূমিকায় রিয়াদ ও তেহরানের সম্পর্ক আবার আরম্ভ হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বিশাল বিষয়। একসময় প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া দুই দেশ আবার একত্রিত হচ্ছে কূটনৈতিক মেলবন্ধনে। এতে দুই দেশের মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়া বিনিময়ে দুই দেশের অর্থনীতি আরা চাঙা হবে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এর প্রভাব থাকবে ইতিবাচক। স্থিতিশীল থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। রিয়াদ ও তেহরানের সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে ইরানের মিত্র দেশগুলো সৌদি আরবের প্রতি নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসবে। তারা আর সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সংঘাতে জড়াবে না। চুক্তির বিষয়ে দুই দেশের যৌথ বিবৃতি প্রকাশের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কারবি বলেছেন, ‘ওই অঞ্চলে যেকোনো ধরনের উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা আমাদের স্বার্থকেই রক্ষা করবে।’ তবে এই চুক্তি সম্পাদনের দিন হোয়াইট হাউস স্বাগত জানায় দুই দেশকে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন দিন দিন প্রভূত উন্নতি করছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে চীন ঈর্ষণীয় উন্নতি করছে। আঞ্চলিক অর্থনীতিকে চীন প্রযুক্তিতে রূপান্তর করতে চাচ্ছে, যা চীনের সক্ষমতা ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে চীন চাইছে নিজেদের প্রথম স্থানে নিয়ে আসতে এবং বিশ্ব রাজনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করতে চায় চীন। সেই লক্ষ্যে তারা আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও সামরিক খাতে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। তারই একটি ফলপ্রসূ উদ্যোগ হচ্ছে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের শত্রুপ্রতিম দুই দেশের বন্ধুপ্রতিম হিসেবে আবার আত্মপ্রকাশ করা, যা চীনের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কয়েক দশক ধরে চলা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কিছুটা হলেও এবার খর্ব হতে পারে। ওয়াশিংটনভিত্তিক কুইন্সি ইনস্টিটিউটের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট শুক্রবার এক টুইটে লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ‘মধ্যস্থতাকারী’র ভূমিকাকে হুমকি বলে মনে করছেন। কিন্তু রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হবে। মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় এই অঞ্চলে নিরাপত্তা প্রদানের নামে মার্কিন আধিপত্যে ভাগ বসাতে চাচ্ছে চীন। চীন এ অঞ্চলে তার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান অবকাঠামোর শিল্পভিত্তিক সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করতে চায়। ফলে পশ্চিমা জোট ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চীনসহ সব ক্ষমতাধর মোড়লের কাছে এই মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠেছে কূটনীতির যথার্থ ক্ষেত্র। এতে ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা উপসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটাই মূল বিবেচ্য বিশ্ববাসীর জন্য।

শিক্ষার্থী

সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়