ব্যক্তি সচেতন হলে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সম্ভব

মো. মিঠুন: স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল, আর এ সুস্বাস্থ্য অর্জনের মাধ্যমেই একজন মানুষ ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে। একজন মানুষের স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে, তবে দৈনন্দিন কোনো কাজেই মন বসানো যায় না। স্বাস্থ্যহীন মানুষের যতই অর্থসম্পদ থাকুক না কেন যদি তার শারীরিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ই ভালো না থাকে, তবে সে কখনোই সুখী ও সুন্দর মানুষ হতে পারে না। অনেকেই মনে করে, শারীরিকভাবে কোনো কঠিন রোগ না থাকলেই সে শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষ। কিন্তু স্বাস্থ্য বিষয়টা আরও ব্যাপক। বহুকাল থেকেই মানুষ ভালো স্বাস্থ্য অর্জন ও সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়ার লক্ষ্যে অনেক কিছুই করে আসছে। যেমন পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা, সময়মতো ঘুমাতে যাওয়া এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা। কারও আবার সাইক্লিং ও নিয়মিত হাঁটার অভ্যাসও ছিল। কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষ এসব ভালো অভ্যাস থেকে দিনকে দিন সরে আসার ফলে আজ মানুষ তার সুস্বাস্থ্যের বদলে কুস্বাস্থ্য অর্জন করছে। কিছু ভুল মানুষ নিজে করছে, আর কিছু সমস্যা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে হচ্ছে, যার দরুন ব্যক্তিপর্যায়ে স্বাস্থ্যহানির মতো অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। সুস্থ থাকতে হলে সুষম খাদ্য যেমন গ্রহণ করতে হবে, ঠিক অনুরূপভাবে অস্বাস্থ্যকর ও প্রিজারভেটিভযুক্ত জাংক ফুড, অতিরিক্ত চিনি ও টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবার গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখাটাও দরকার। আজকাল প্রতিনিয়ত আমাদের মধ্যে অসংক্রামোক রোগ, যেমনÑহার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য হƒদরোগ, স্ট্রোক (মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ), ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেশি। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে সচেতন করা গেলে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর ফলে অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় কমানো সম্ভব। বর্তমানে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এক শ্রেণির মানুষ খাদ্যশস্য উৎপাদনে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ক্রেতার যেমন স্বাস্থ্যহানি ঘটছে, ঠিক তেমনি একইভাবে কৃষকেরও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে মনিটরিংয়ের অভাবের জন্য এ সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাইরের খোলা খাবার গ্রহণের ফলে আমরা অসুস্থ হচ্ছি, কিন্তু প্যাকেটজাতীয় খাবার এবং অতি মাত্রায় টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবার খেয়ে আমরা আরও বেশি দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। খাদ্যে ফরমালিন আছে বলে আমরা অনেকেই ফলমূল, শাকসবজি-জাতীয় খাবার কমিয়ে প্যাকেটজাতীয় খাবার খেয়ে থাকি; কিন্তু ফরমালিনের ক্ষতির চেয়েও প্যাকেট ও ফাস্টফুড-জাতীয় খাবার খেয়ে আমরা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) অসংক্রামক ব্যধি নিয়ন্ত্রণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ এক-তৃতীয়ংশ কমাতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা তা কতটুকু কমাতে পেরেছি? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১২ সালের এক জরিপমতে, পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ মানুষ অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনের একজনের মৃত্যু এ কারণে ঘটছে। আর এর জন্য দায়ী অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বায়ু, পানি, রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি। এসব  ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তু মানুষের শরীরে ১০০ ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ব্যাপারগুলো কমিয়ে আনার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর থাকলেও বাস্তবে আমাদের দেশে এর কতটা প্রতিকার করা যাচ্ছে? আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, স্বাস্থ্য মানে তাদের কাছে কেবলই চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা, যেমন অনেক হাসপাতাল তৈরি করা, নার্সিং সেবার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা, অপারেশন-সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি বাড়ানো প্রভৃতি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রায় ৩৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। প্রতি বছরেই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষ কতটা উপকৃত হচ্ছে, সেটা আমাদের এখনও বোধগম্য নয়। আমরা অনেকেই আছি যে, আগে নিজ অর্থ খরচ করে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করি, তার পরে আবার অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা যদি আগে থেকে সচেতন ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারি, তবে আমাদের অসুস্থ হতে হবে না। সেক্ষেত্রে অর্থ খরচ করে ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা গ্রহণও করতে হবে না। আমাদের সরকার যে পরিমাণ চিকিৎসা খাতে সাবসিটি দিচ্ছে, সেই একই অর্থ যদি তারা স্বাস্থ্য খাতে সাবসিটি না দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য কীভাবে ভালো রাখা যায় এবং মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেখানে অর্থ খরচ করত, তাহলে নি¤œ ও নি¤œ মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের চিকিৎসা খাতে অপ্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে হতো না। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সচেতন করতে হবে যে, স্বাস্থ্য মানে সুধু চিকিৎসা নয়। স্বাস্থ্য হলো সেই জিনিস যা অর্থ খরচ করে নয়, বরং শরীরকে কীভাবে ভালো রাখা যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে জোর দেয়া। তাহলে স্বাস্থ্য ও অর্থ দুটোই ভালো রাখা সম্ভব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, স্বাস্থ্য ভালো রাখার দায় শুধু রাষ্ট্রের একার কাজ নয়, ব্যক্তিপর্যায় থেকে নিজ স্বাস্থ্য কীভাবে ভালো রাখা যায়, সে জায়গাতে নিজের কিছু ভূমিকা রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস তৈরি করা এবং এর পাশাপাশি স্বল্প দূরত্বে সাইক্লিং করা। পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করা। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য স্কুল-কলেজ ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রাখা। এছাড়া মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি প্ল্যাটফর্ম বা ফাউন্ডেশন অথবা কমিশন গঠন করা গেলে মানুষের স্বাস্থ্য কীভাবে ভালো রাখা যায় এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে এই প্ল্যাটফর্ম বা ফাউন্ডেশন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবে। চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলেও শুধু চিকিৎসাসেবা প্রদানের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বরং আমাদের রোগ প্রতিরোধমূলক এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেন মানুষ শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই সুস্থ থাকতে পারে। এর ফলে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী দেখাচ্ছেন, তা সঠিক ও সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

                উন্নয়ন কর্মী