মো. আতিকুর রহমান: পরিবেশ বিপর্যয় ও দুর্যোগগত সমস্যা সামগ্রিকভাবে একটি দেশের জাতীয় সমস্যা। কাজেই ওই সমস্যা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে যা দরকার তা হলো দেশের প্রতিটি মানুষের সঠিক চেতনাবোধ ও সচেতনতা। দেশের প্রতিটি মানুষ যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে পরিবেশ বিপর্যয় ও যেকোনো রকমের দুর্যোগের কবল থেকে অতি সহজেই নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করা সম্ভব, যা অধিক জরুরি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো এমন নিঃশব্দ শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।
সম্প্রতি আবহাওয়া অধিদপ্তরের আভাস অনুযায়ী, আগামী ১৩-১৫ মের মধ্যে এ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলের ওপর দিয়ে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’। এখন পর্যন্ত এর গতিমুখ দেশের দক্ষিণ-পূর্বে এবং মিয়ানমার উপকূলের দিকে। তবে বঙ্গোপসাগরে গভীর নি¤œচাপের পর এর চূড়ান্ত গতিপথ নিশ্চিত হওয়া যাবে; কিন্তু এ ঘূর্ণিঝড়কে সামনে রেখে কতটা প্রস্তুত হয়েছে উপকূলের জনগণ। বিশেষ করে খুলনার পাইকগাছা-কয়রা কিংবা সাতক্ষীরার শ্যামনগর-আশাশুনির উপকূলীয় জনপদের দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি কতটুকু? বিশেষ করে উপকূলীয় জনগণকে রক্ষায় কিংবা তাদের নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় প্রশাসন কতটা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেÑসেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
দুর্যোগকালীন দেখা যায়, উপকূলীয় সাইক্লোন শেল্টারগুলো বসবাসের জন্য উপযোগী না। কোনটা ভেঙে পড়ছে, কোনটা ময়লা-বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। আবার কোথাও জনসংখ্যা অনুযায়ী সাইক্লোন শেল্টার অপ্রতুল। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাইক্লোন শেল্টার বৃদ্ধি করা হবে বা মানসম্মত করে তৈরি করা হবেÑএমন আশ্বাস দেয়া হলেও বেশিরভাগ জায়গায় তা কার্যকর হয় না। দেখা যায়, দুর্যোগকালীন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সব খাবার পানির পুকুর বা টিউবওয়েল ডুবে যায়। এতে ওই সময়কালে তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা যায়। প্রতি বছর এ উপকূল বিধ্বস্ত হয় কিন্তু আজও তার কোনো স্থায়ী সমাধান মেলেনি, যা দুঃখজনক।
এমন এক পরিস্থিতিতে ওই জনপদের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে, তাদের বসবাসের জন্য এসব অঞ্চলকে উপযোগী করে তুলতে স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ অতি প্রয়োজন; যা ছাড়া কোনোভাবেই এসব জনপদকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে সরকার স্থায়ী বেড়িবাঁধ, নিরাপদ খাওয়ার পানির জন্য তিন হাজার লিটারের পানির ট্যাংকসহ বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে স্বল্প কিছু কাজ দৃশ্যমান হলেও বেশিরভাগ কাজ অধরা স্বপ্ন হয়ে পড়ে আছে। এর দৃশ্যমান সমাধান জরুরি। এজন্য সরকারি কর্মপরিকল্পনার কৌশল পরিবর্তন ছাড়া কোনোভাবেই এসব কাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়। বরং এভাবে কাজের গতি হেলায় হারাতে বসলে একটি সময় এ দেশের মানচিত্র থেকে এসব অঞ্চল বিলীন হয়ে যাবে; যা আমাদের দেশ ও দশের উন্নয়নে বড় সংকট তৈরি করবে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলজুড়ে পরিবেশবিরোধী উন্নয়ন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে তোলার জন্য শিল্পপতিরাও এখন উপকূলকে বেছে নিচ্ছেন; যা আমাদের পরিবেশকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের যে টাকা উপকূলে বরাদ্দ হচ্ছে তা অপ্রতুল। আর যা আসছে তাতেও নামমাত্র কাজ হচ্ছে; এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় ১৯টি জেলায় বসবাসরত মানুষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিকারে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করা অধিক জরুরি।
যদিও ভাবতে কষ্ট লাগে, যখন দেখি আমাদের পাশের দেশগুলো নিজেদের ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য উপযোগী বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তারা তাদের জনগণকে অধিক সচেতন করে তুলতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, সেখানে আমরা নিজেদের অধিক উদাসীনতা ও কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দুর্যোগপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছি, যা নিজেদের জন্য তো বটেই, ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্যও ভয়াবহ হুমকির কারণ বলে মনে করছি। বর্তমানে দেশের ভৌগোলিক অবস্থা, নিকটবর্তী দেশগুলোর দ্বারা অধিক হারে পরিবেশ দূষণ ও আগ্রাসন, দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় আধুনিক উপকরণের স্বল্পতা, অভিজ্ঞও দক্ষ জনবলের ঘাটতি, পরিবেশ রক্ষায় নিজেদের অধিক অবহেলা ও অসচেতনতা, সংশ্লিষ্টদের চরম অব্যবস্থাপনা ও ব্যর্থতা, দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণকে অধিক সচেতন ও দক্ষ করে তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবেশগত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচির স্বল্পতা, পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের অধিক আগ্রহহীনতা, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে ওই বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব কম দেয়া, শিক্ষার্থীদের পরিবেশবান্ধব শিক্ষাদানে এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিক অনীহা, অতীতের দুর্যোগের তাণ্ডবলীলা থেকে শিক্ষা নিয়ে তা প্রতিরোধে নিজেদের পূর্বপ্রস্তুতি রাখার ক্ষেত্রে অধিক উদাসীনতা ও ব্যর্থতা, দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্যের সাহায্যের ওপর অধিক নির্ভরশীলতা, দুর্যোগের ক্ষতিকে নিয়তি ও ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকার হীনপ্রবণতা, দরিদ্রতা, সময়ের কাজ সময়মতো না করার অধিক প্রবণতা, অধিকাংশ কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক সমন্বয়হীনতা, এক সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প অন্য সরকার কর্তৃক বন্ধ করার হীনপ্রবণতা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অর্থ ছাড়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের ক্ষেত্রে নানা শর্ত ও জটিলতা, সরকারি কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অধিক দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, অর্থজালিয়াতি ও দুর্নীতি, দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দুর্বলদুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামোসহ উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ শিল্পোন্নত দেশগুলো দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে এ দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিনিয়ত নিজেরা পরিবেশ দূষণ করে, নদ-নদী ভরাট করে, আন্দোলন-সংগ্রামের নামে প্রতিপক্ষকে বাধাস্বরূপ রাস্তার দুই ধারের শতশত গাছ কেটে ব্যারিকেড দিতে রাজনৈতিক দলগুলো যে আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে, যা এ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্টের ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। এমনি নানাবিধ কারণে প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে, যার প্রাপ্তি স্বরূপ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের গ্রাস করছে; যা কিনা ইতোমধ্যেই বিশ্বের মানচিত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে এদেশকে আখ্যায়িত করা হয়েছে; যা দেশ ও জাতির জন্য অধিক উদ্বেগ ও ভীতির কারণ। দ্বিধা নেই, পরিবেশ সম্পর্কে নিজেদের অধিক অজ্ঞতা ও অসচেতনতা, সেই সঙ্গে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দ্বারা অতিমাত্রায় পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের প্রকৃতি হারাচ্ছে তার নিজস্ব ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা, অন্যদিকে আমরাসহ চারপাশের অসংখ্য জীবের জীবন হচ্ছে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত, যা হয়তো কারোর জন্যই কাম্য নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব সরকারসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অধিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি যেকোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতি ও অধিক দক্ষ করে গড়ে তুলতে সবাইকে ওই কাজে অধিক আত্মনিয়োগ করতে হবে, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসের হাত থেকে নিজেদের ও ভবিষ্যৎ প্রজš§কে রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সংশ্লিষ্টদের চরম অব্যবস্থাপনা, নিজেদের অধিক উদাসীনতা ও যথাযথ পরিচর্যার অভাবে দেশের অধিকাংশ নদ-নদী আজ শুকিয়ে তা ক্রমেই মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। নদ-নদী ভরাট করে অধিক লোভে ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে। কারণে অকারণে বৃক্ষ নিধন করে একের পর এক বন উজাড় করা হচ্ছে। এরই সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে দেশে অপরিকল্পিত অধিক জনসংখ্যা, ব্যাপক দরিদ্রতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কৃষি জমিতে অত্যাধিক রাসায়নিক ও কীটনাশক সার ব্যবহারের প্রবণতা, অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গমন, অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহার, সামাজিক অনগ্রসরতাসহ পরিবেশ বিষয়ে অধিক জনসচেতনতার অভাব যা কি না এখানকার পরিবেশকে ক্রমাগত আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। কিন্তু নিজেদের একটু সচেতনতা, সজাগ দৃষ্টি ও সদিচ্ছাই পারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। কেননা আমরা চাইলেই অহেতুক বৃক্ষনিধন বন্ধ করে ষোল কোটি মানুষ ষোল কোটি গাছ লাগিয়ে গ্রিন হাউস এফেক্টের সর্বনাশা থাবা থেকে কিছুটা হলেও পারি নিজের ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে। এ ক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন নিজেদের অধিক সদিচ্ছা, যা পরিবেশের ভারসাম্য ও বিপর্যয় রোধে অধিক জরুরি। বলাবাহুল্য, বিভিন্ন সরকারের আমলে আমরা দেখেছি সংশ্লিষ্টদের ওই কাজে অধিক ব্যর্থতা এবং সময়ের কাজ সময়মতো না করার অধিক প্রবণতা, যা এ দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ ও তীব্রতর করেছে, যা অধিক বেদনাদায়ক। এখনও যদি আমরা দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারি, তবে এর পরিণতি হবে সবার জন্যই অধিক ভয়াবহ, যা বহন করার শক্তি ও সমর্থন তখন হয়তো কারও নাও থাকতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিবেশের ভারসাম্য ও দূষণ রোধে সম্ভাব্য সবধরনের উপায় চিহ্নিতকরণ এবং ওই বিষয় সম্পর্কে দেশের প্রতিটি জনগণকে সমানভাবে সচেতন ও দায়িত্বশীলকরণ অধিক জরুরি। ঠিক অনুরূপভাবে সরকারকে দেশে পরিকল্পিত ও শক্তিশালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারে অধিক গুরুত্বারোপ করাটাকেও অধিক জরুরি।
প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাইক্লোন, টর্নেডো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ভূমি ও পাহাড় ধস, অগ্নিকাণ্ড, নদীভাঙন ইত্যাদি এ দেশের জনগণের জীবন-জীবিকা, সহায়-সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদসহ পরিবেশের বিপুল ক্ষতিসাধন করছে। এতে রাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে খরচ হিসেবে ব্যয় করা হচ্ছে, যা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় দুর্যোগ ঘটার আগেই তা প্রতিরোধে গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করলে অধিক সুফল পাওয়া যাবে। এতে এক দিকে সরকারের অর্থের অপচয় যেমন রোধ করা সম্ভব হবে, ঠিক তেমনি স্থায়ীভাবে দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে। যদিও এ কথাটি সত্য, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা সরকার তথা কারও একার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়, যদি না জনগণ ওই কাজে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ না করে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রাণালয়কে যেমন দুর্যোগ প্রতিরোধে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, ঠিক তেমনি যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রতিটি জনগণকে সময়মতো পূর্বপ্রস্তুতি ও সচেতন করে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যদিও বর্তমান সময়কাল থেকে শুরু করে আগামী জুন-জুলাই পর্যন্ত ওই সময়ের মধ্যে এ দেশে অপ্রত্যাশিত ছোট ও বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, অধিক অনাবৃষ্টি, বজ্রপাত ও পাহাড়ধসের প্রবণতা অধিক দেখা যায়। আর এসব দুর্যোগে নিজেদের অধিক উদাসীনতা ও সতর্কতার অভাবে দুর্যোগকবলিত বিভিন্ন স্থানে মৃত মানুষের লাশের সারি যেমন দীর্ঘ হয়, ঠিক তেমনি অবাদি শস্যও ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। কিন্তু যদি এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সময়মতো নিজের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সংশ্লিষ্টদের তরফ থেকে একটু নজরদারি, দুর্যোগ পূর্বাভাসসহ দুর্যোগকবলিত এলাকার জনগণকে দুর্যোগ প্রতিরোধে অধিক সতর্ক ও সজাগ করা হয়, সে ক্ষেত্রে দুর্যোগকবলিত এলাকার ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাই পরিবেশ বিপর্যয়কারী নিঃশব্দে আসা এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের জানমাল রক্ষায় কীভাবে অধিক সচেতন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজেদের পূর্বপ্রস্তুতি রাখা সম্ভব হয় সেই বিষয়ে সবাইকে অধিক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
সরকারসহ দেশের প্রতিটি নাগরিককে দুর্যোগ মোকাবিলায় করণীয় বিষয় সম্পর্কে অধিক সচেতন ও সজাগ হতে প্রয়োজনীয় যা যা করণীয় তাই দ্রুত গ্রহণ করতে হবে। এ কাজে সরকারকে দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও তার প্রতিরোধে জনগণ যেন ওই বিষয়গুলোর ওপর অধিক গুরুত্ব দেয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া তা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় কর্মপদ্ধতি গ্রহণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্টদের অধিক সচেষ্ট হতে হবে। ওই কাজ হিসেবে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দেশের অধিক দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোকে আগে চিহ্নিত করতে হবে এবং সেখানকার জনগণকে অধিক হারে দুর্যোগ প্রতিরোধের বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তা মোকাবিলার জন্য দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ওই কাজে সব ধরনের সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। দলীয় প্রভাবমুক্ত দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং গবেষকদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ে দুর্যোগ প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় কমিটি তৈরি করতে হবে, যে কমিটি শুধু দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক নিত্য-নতুন কৌশল তৈরি এবং তা জবাবদিহিতার সঙ্গে দ্রুত বাস্তবায়নে অধিক সচেষ্ট থাকবে। প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ প্রতিরোধ বিষয় অধিক ক্যাম্প স্থাপন ও সেবা প্রদানে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে পরিবেশবিষয়ক তথ্য প্রদানের জন্য আধুনিক ও যুগোপযোগী সেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় দুর্যোগ-পরবর্তী জনগণের পুনর্বাসন, খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও যথাযথ মজুত থাকতে হবে। যদিও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ওই ত্রাণসামগ্রী বিতরণ নিয়েও অনেক সময় দলীয় কোন্দল ও নানা ধরনের অসঙ্গতির কথাও শোনা যায়, তা নিরাময়ে অধিক সচেষ্ট হতে হবে। দেশে অবস্থিত প্রতিটি নাজুক দুর্যোগ পূর্বাভাস কেন্দ্রকে আধুনিক ও অধিক কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেগুলোয় সেবার মান বাড়াতে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরকে আরও অধিক কার্যকর, আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনগণের আগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের মৃতপ্রায় নদীগুলোকে বাঁচাতে নদীগুলোর যথাযথ পরির্চযা, নদীশাসন ও সবধরনের আগ্রাসন বন্ধ করে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সংশ্লিষ্টদের অধিক উদ্যোগী হতে হবে। নদীর পানির ভয়াবহ দূষণ রোধে সেন্ট্রাল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গ্রহণ করে সব ধরনের বর্জ্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে পতিত ও তা পরিশোধন করার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পরিবেশবান্ধব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিল্পকারখানা ভয়াবহ দূষণ প্রতিরোধে নদীর আশপাশে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে কারখানার অব্যবহƒত ক্ষতিকর কেমিক্যাল স্থায়ীভাবে নিজ নিজ কারখানায় সংরক্ষণ ও তা পরিশোধনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি জমিতে অধিক রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে কৃষিবিদদের সহায়তায় প্রাকৃতিক সার ব্যবহারের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে। শব্দদূষণ রোধে হাইড্রোলিক হর্ন এবং যত্রতত্র মাইক বাজানোর বিরুদ্ধে কঠোর আইনের ব্যবস্থা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমগুলোকে দুর্যোগ মোকাবিলায় জনগণের তাৎক্ষণিক করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে অধিক সচেতন ও সজাগ করতে দুর্যোগ প্রতিরোধবিষয়ক ভিডিও ফুটেজ ও ঘন ঘন আবহাওয়া সংকেত প্রদানে সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশ প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ বিপর্যয় ও দুর্যোগগত সমস্যা সামগ্রিকভাবে একটি দেশের জাতীয় সমস্যা। কাজেই ওই সমস্যা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ আইনই যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে যা দরকার তা হলো দেশের প্রতিটি মানুষের সঠিক চেতনাবোধ। দেশের প্রতিটি মানুষ যদি পরিবেশ বিপর্যয়ের সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হন, তাহলে পরিবেশ বিপর্যয় ও যেকোনো রকমের দুর্যোগের কবল থেকে আমরা অতি সহজেই নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষা করতে পারব, যা অধিক জরুরি।
বর্তমান বাস্তবতায় উপকূলজুড়ে যে সংকট রয়েছে তা নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী এবং আন্তরিক হতে হবে। বিশেষ করে বহু দিনের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং সুপেয় পানি নিশ্চিত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থা এক না রেখে ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার কথা চিন্তা করে চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভিন্নতা আনতে হবে। সর্বোপরি শুধু দুর্যোগকালীন তাদের বাঁচাতে কাজ না করে পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক তাদের বসতভিটা, ঘর-বাড়ি, জমি-জমা রক্ষার বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো এমন নিঃশব্দ শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই যত দ্রুত সম্ভব সরকারের উচিত হবে নিজেদের দক্ষতা, সততা ও বিশেষজ্ঞদের ধ্যান-ধারণাকে নিয়ে সমন্বিত প্রশাসনিক পদক্ষেপকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে আমাদের এ বিপন্ন পরিবেশের মরণ ছোবল থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য একটি বাসযোগ্য নিরাপদ ও সুন্দর স্বদেশ নিশ্চিত করা; যা আমাদের সবার জন্যই অধিক জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার তথা এদেশের প্রতিটি জনগণের ভেতর সেই চেতনাবোধ ও অধিক সদিচ্ছা জাগ্রত হোক।
মুক্ত লেখক