এমএ কাদের: মানুষ তার স্বাভাবিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সঞ্চয় করে। আর এ অর্থ সঞ্চয় করতে গিয়ে অপকর্ম ও দুর্নীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। রোগ-শোকে ভালো চিকিৎসা এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। অন্য চাহিদাগুলোর জন্য অধিক সঞ্চয়ের প্রয়োজন হয় না।
সব মানুষই সুখী হতে চায়, আর এ সুখ অনেকটা নিশ্চিত করে টাকা। এ কারণেই বৈধ-অবৈধভাবে মানুষ সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাছাড়া রোগ-শোক ও সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও অধিক চিন্তায় মানুষের সুখ নষ্ট হয়। বাংলাদেশের মানুষ সুখের মাপকাঠিতে অনেক পিছিয়ে। পৃথিবীর ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৪-তে। আর সবচেয়ে সুখী দেশ হলো ফিনল্যান্ড। এছাড়া কানাডা, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্কÑএসব দেশে সরকারিভাবে শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করার কারণেই এরা আজ সুখী দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এসব দেশে দুর্নীতি নেই বললেই চলে। তাছাড়া শিক্ষার হারও অনেক বেশি।
পৃথিবীর অনেক দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ফ্রি হওয়ার কারণে শিক্ষার হার অনেক বেশি এবং দুর্নীতিও কম। এ দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা অন্যতম। পৃথিবীর মধ্যে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, অস্ট্রিয়াÑএসব দেশের জনগণের মানসিক চাপ না থাকায় তারা অনেক সুখী।
মানুষ নিশ্চিত সুখের জন্য আমাদের দেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা সুখী দেশগুলোয় পাচার করে প্রাইম লোকেশনে বাড়ি ক্রয় করে সেকেন্ড হোম নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কানাডার বেগমপাড়াসহ ইংল্যান্ড, আমেরিকা, মালয়েশিয়া ও দুবাই। দুদকের তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হচ্ছে। শুধু দুবাই শহরেই ৪৫৯ জন বাংলাদেশির নাম পাওয়া গেছে, যারা প্রচুর অর্থ পাচার করে বাড়ি কিনেছে। এতে একদিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার চরম ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা এখনই থামানো না গেলে ক্রমান্বয়ে অর্থপাচার বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় বাধার সম্মুখীন হতে হবে।
পৃথিবীর অন্যতম সুখী দেশ ফিনল্যান্ড। গত ছয় বছর ধরে একটানা সুখের মাপকাঠিতে এক নম্বরে আছে দেশটি। এর অন্যতম কারণ হলো দেশটিতে মানুষের মৌলিক চাহিদার সবগুলোই সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়। আর এ কারণেই মানুষের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এদেশ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাÑসবার জন্য সমবণ্টন নিশ্চিত করা হয়। সন্তান জšে§র পর থেকে মা তার নিজের সন্তানকে লালন-পালনের জন্য সরকার থেকে একটা বড় ভাতা পেয়ে থাকে।
বর্তমানে জনবহুল আমাদের এ দেশে অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। তাদের কর্মসংস্থানের তেমন কোনো সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিবার, সমাজ ও দেশের বেকারত্বের বোঝা সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমাদের দেশে চিকিৎসা ও শিক্ষা সবার জন্য জাতীয়ভাবে নিশ্চিত করা হলে মানুষ মানসিক চাপমুক্ত হয়ে নিশ্চিতভাবে সুখী হবে এবং অধিক সঞ্চয় করা থেকে বিরত থাকবে। ফলে দুর্নীতি করে সঞ্চয় করার দরকার হবে না। আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা আর অবৈধভাবে দেশের কষ্টার্জিত টাকা বিদেশে পাচার করবে না।
চিকিৎসা ও শিক্ষা সব নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করলে দেশের অনেক অবকাঠামো ও কর্মের সৃষ্টি হবে। এতে করে বেকার সমস্যা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলে প্রতিদিন দেশের হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাওয়া বন্ধ হবে। ফলে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে যাওয়া বন্ধ হবে। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সৃষ্টি হলে আমাদের আশপাশের দেশ নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়তে আসবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে এবং দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করলে দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে, এতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা একেবারেই কমে আসবে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান হওয়ার পর বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী দেশে শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করে বিদেশে রাপ্তানি করলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি হলে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীরা দেশেই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী এদেশে পড়তে এলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
দেশের চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। বিশ্বের সুখী দেশগুলোর প্রত্যেক নাগরিকের আয়ের একটা অংশ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার নিয়ম আছে। আমাদের দেশের নাগরিকদের আয়ের ২৫ শতাংশ ট্যাক্স হিসেবে সরকারের কোষাগারে জমা করার নিয়ম করলে চিকিৎসা ও শিক্ষা এ দুটি বিষয়ে অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়ন সহজ হবে। দেশের ধনী-গরিব প্রতি মানুষ সরকারের কাছ থেকে সমান সুযোগ-সুবিধা পাবে, এতে প্রত্যেকটি মানুষই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকবে। সন্তানের লেখাপড়া ও নিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকারের ওপরে থাকায় এবং অসুস্থ রোগীদের দেশেই চিকিৎসা হওয়ায় মানুষের কোনো মানসিক চাপ থাকবে না। ফলে তারা নিশ্চিত সুখী হবে।
বহির্বিশ্বে যে দেশের মানুষ যত সুখী, সে দেশ তত উন্নত। দেশের মানুষের সুখের সঙ্গে তার উন্নয়ন নির্ভর করে। যার মানসিক চাপ যত কম, সে তত সুখী। মানুষের মানসিক চাপে তার আয়ুর ওপর প্রভাব পড়ে। যে দেশের মানুষের মানসিক চাপ যত কম, আয়ু তত বেশি। আমাদের দেশে চিকিৎসা ও শিক্ষা জাতীয়ভাবে নিশ্চিত করা হলে দেশের জনগণ সুখী হবে। দেশের একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে। দেশ থেকে সন্ত্রাস-দুর্নীতি বন্ধ হবে, মাদক থেকে অনেকে ফিরে আসবে। সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকায় আমাদের দেশে মিল-কলকারখানায় বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশিরা আগ্রহী হবে। এতে করে ২০৪১ সালে নয়, এর অনেক আগেই দেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট
makader958Ñgmail.com