ঋণ দিতে অনীহা ব্যাংকের চামড়া খাতের খেলাপি ঋণ ১৬০০ কোটি টাকা

রোহান রাজিব: চামড়া খাতে খেলাপি হওয়ার ভয়ে ঋণ দিতে রীতিমতো অনীহা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। প্রতি বছরই কমছে ঋণের পরিমাণ। এ বছরে যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে, তা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৮৪ কোটি টাকা কম। তবে উল্টো চিত্র খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে। এ খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের মার্চ শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কয়েকজন ব্যাংকার জানান, চামড়া খাতের জন্য প্রতি বছর ট্যানারিগুলো ঋণ নিয়ে থাকে, তা যথাসময়ে পরিশোধ করে না। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ না করার কারণে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ব্যাংকগুলো এখন ভালো গ্রাহক পেলে এ খাতে ঋণ দেয়। ভালো গ্রাহক না পেলে ঋণ দেয় না। দেখা যায়, অধিকাংশ গ্রাহক আগের ঋণ পরিশোধ করে না, তারাই নতুন ঋণ নিতে আসে। এসব গ্রাহককে ঋণ দিতে ব্যাংক অনীহা দেখায়। তাই এ খাতে ঋণের পরিমাণ কমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে চামড়া খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে এক হাজার ৫৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বা ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে এ খাতে ঋণ বিতরণের স্থিতি ছিল ১২ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫৪১ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

খেলাপি হওয়ার ভয়ে এবার সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো কাঁচা চামড়া কেনার জন্য ঋণ কমিয়েছে। কারণ এ খাতের আগের ঋণের বড় অংশই খেলাপি। এ কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চায় না। এ বছর কোরবানির চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ঋণ ১০টি ব্যাংক ২৫৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ঋণের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় ১৮৪ কোটি টাকা কম। গত বছরে চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪৩

কোটি টাকা। আর ২০২১ ও ২০২০ সালে ছিল যথাক্রমে ৫৮৩ কোটি এবং ৬৪৪ কোটি টাকা।

চামড়া খাতসংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, কোরবানি ঈদের চামড়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয় কয়েকটি ব্যাংক, কিন্তু এটা শুভংকরের ফাঁকি। কেননা বরাদ্দ করা অর্থের মাত্র ১০ শতাংশ বণ্টন হয়। সেটাও আবার যেসব ট্যানারি ব্যবসায়ীর সক্ষমতা থাকে, কেবল তাদেরই আবার ঋণ দেয় ব্যাংক। যারা বকেয়া পরিশোধ করতে পারে না, তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করে কিছু অংশ ঋণ দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা নতুন ঋণ পায় না। এই খাতে আগের যে টাকা বকেয়া আছে, সেটা ব্লকে নিয়ে নতুন করে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা অর্থায়ন করা প্রয়োজন। তা না হলে খাতটির সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। এভাবে ঋণের পরিমাণ কমতে থাকলে এ খাত উঠে দাঁড়াতে পারবে না।

জানা যায়, ঈদুল আজহায় আড়তদারদের মাধ্যমে প্রচুর চামড়া সংগ্রহ করেন ট্যানারি মালিকরা। ফলে এ সময় তাদের বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হয়। তাদের এই অর্থের জোগান দিতে প্রতি বছরই ঋণ দিয়ে আসছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এবার সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংক চামড়া ব্যবসায়ীদের ঋণ দেবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলোÑসোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, আল-আরাফাহ্, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক। এর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংক বাদে অপর ১০টি ব্যাংক নির্দিষ্ট করে তাদের ঋণের পরিমাণ উল্লেখ করেছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের মধ্যে চামড়া কিনতে বেশি ঋণ দিচ্ছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির এবার ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত বছর ব্যাংকটি এ খাতে ১২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে অগ্রণী ব্যাংক। গতবার ব্যাংকটির এ খাতে বরাদ্দ দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক এবার ২৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। গত বছরও ব্যাংকটি এ খাতে বরাদ্দ দিয়েছিল ২৫ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক এবার ৩০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত বছরও ব্যাংকটি ঋণ বরাদ্দ দিয়েছিল ৩০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া এবার বেসিক ব্যাংক চামড়া খাতে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দেবে বলে জানিয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেবে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক। গতবার ব্যাংকটি ঋণ দিতে বরাদ্দ রেখেছিল পাঁচ কোটি ২০ লাখ টাকা। গতবার চামড়া কিনতে ইসলামী ব্যাংক ১৭০টি কোটি টাকা বরাদ্দ রাখলেও এবার মাত্র পাঁচ কোটি ৩১ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার এনসিসি ব্যাংক দুই কোটি টাকা ঋণ দেবে। গতবার ব্যাংকটি এ খাতে বরাদ্দ দিয়েছিল মাত্র ৫০ লাখ টাকা। দি সিটি ব্যাংক গতবার ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখলেও এবার দেবে মাত্র ২০ লাখ টাকা। এ ছাড়া কমার্স ব্যাংক এবার ঋণ দেবে পাঁচ কোটি টাকা। গতবার ব্যাংকটি কোনো ঋণ দিয়েছিল কি না, সেটি জানা যায়নি। এর বাইরে এবার সাউথইস্ট ব্যাংক গ্রাহকদের উপযুক্ত চাহিদার ভিত্তিতে এ খাতে ঋণ দেবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নতুন নীতিমালার আলোকে ঋণ দেয়া হয়। তবে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করে না। তাই এ খাতে ব্যাংকগুলো এখন যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়। যাচাই-বাছাইয়ে যারা টেকে, তাদেরই ঋণ দেয়া হয়।