নিতাই চন্দ্র রায় : হাওরাঞ্চলের দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা বিপর্যস্ত করে তুলেছে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা। ২০ বছরেও দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে এ ধরনের বন্যা হতে কেউ দেখেনি। দেশের উত্তরাঞ্চল খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত ভাণ্ডার। এখানে দানাশস্য ছাড়াও নানা ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন হয়। উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও ফলমূল দেশের মানুষের খাদ্যপুষ্টি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ-বছর হাওরের ছয়টি জেলায় অকাল বন্যায় বোরোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এজন্য সরকারি হিসাবে প্রায় ১০ লাখ টন ও বেসরকারি হিসাবে ২০ লাখ টন চাল কম উৎপাদন হয়। ফলে গত বছরের তুলনায় চালের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষকে সীমাহীন কষ্টের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এবারের বন্যায় দেশের উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে আউশ, আমন, পাট, শাকসবজিসহ প্রায় সব ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৪০ জেলায় ছয় লাখ ৫২ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে এবার প্রতি হেক্টর জমিতে সাড়ে তিন টন করে চাল উৎপাদন হবে বলে আশা করা হয়েছিল। সে হিসাবে তলিয়ে যাওয়া জমিতে ২৩ লাখ টন চাল হওয়ার কথা। এর অর্ধেক ধান নষ্ট হলেও এবার আউশ ও আমন মৌসুমে কমপক্ষে ১০ লাখ টন চাল পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, গত জুলাই থেকে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে ৪৬ হাজার টন ও বেসরকারিভাবে দুই লাখ ৬২ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে দুই লাখ ৯৫ হাজার টন চাল মজুত আছে। গত বছর এ সময় মজুতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাত লাখ টন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক এসএম আসাদুজ্জামানের অভিমতÑবোরো ও আমন মিলিয়ে এবার ১০ শতাংশ চাল কম উৎপাদন হতে পারে। এতে চালের দাম আরও বেড়ে গেলে গরিব মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই সরকারে উচিত বেসরকারি খাতে আমদানি করা চাল আলোচনার মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক মুনাফা দিয়ে কিনে নেওয়া ও জরুরি ভিত্তিতে মজুত বাড়ানো। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিটের তথ্যমতে, এবারে আমন ও আউশ মিলিয়ে এক কোটি ৫৮ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, আউস ও আমনের চাষ লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছিল। কিন্তু আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে বন্যায় প্রথমে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ ৪০ জেলার ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ধান উৎপাদনের সে লক্ষ্যমাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এবারের বন্যা ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ৬১ শতাংশ ও ১৯৯৮ সালে ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বন্যায় ততটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তারপরও বন্যায় ফসলহানিতে কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার পুকুর ও মাছের ঘের থেকে দুই থেকে তিন লাখ টন মাছ বেরিয়ে গেছে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ অনেকটা লাঘব হবে। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমনের জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা ঠিক নয়। এতে ধানগাছ পচে যেতে পারে। পানি নেমে যাওয়ার অন্তত ১০ দিন পর ধানের চারায় নতুন পাতা গজানো শুরু হলে বিঘাপ্রতি আট কেজি ইউরিয়া ও আট কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। উঁচু জমিতে যেখানে বন্যার পানি ওঠেনি, সেখানে রোপণ করা বাড়ন্ত আমন ধানের গাছ থেকে দু-তিনটি কুশি তুলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ক্ষেতে রোপণ অথবা ফাঁকা স্থান পূরণ করা যেতে পারে। পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাত যেমনÑবিআর৫, বিআর২২, বিআর২৩, ব্রি৩৪, ব্রি৪৬, ব্রি৫৪ ও নাজিরশাইলসহ স্থানীয় জাতগুলো রোপণ করতে হবে। বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া ধান গাছের যাবতীয় পরিচর্যা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যা-পরবর্তী চারাগাছ সম্পূর্ণভাবে মাটিতে লেগে যাওয়ায় ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ৬০ গ্রাম থিওভিট ও ৬০ গ্রাম পটাশ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে পাঁচ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর বিনা চাষে বা স্বল্প চাষে আগাম রবি ফসল করা যেতে পারে। গো-খাদ্যের অভাব পূরণে নেপিয়ার জাম্বো ঘাস ও মাষকলাই চাষ করা যেতে পারে। এজন্য ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ, সার, বীজসহ সময়মতো উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। ফলন বৃদ্ধির জন্য মাঠ পর্যায়ের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের কৃষকের নিবিড় সান্নিধ্যে থাকতে হবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দিনাজপুর ও কুড়িগ্রামে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছ থেকে এনজিওদের সাপ্তাহিক কিস্তিসহ সব ধরনের কৃষিঋণ আদায় স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের প্রত্যাশা, সে আহ্বান যথাযথভাবে প্রতিপালিত হবে।
বন্যার খারাপ দিকের মধ্যে কিছু কল্যাণকর দিকও রয়েছে। বন্যার পলিমাটি জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের বিষাক্ততা হ্রাস করে মাটিকে সজীব করে তোলে। তাই বন্যা-পরবর্তী ফসলের ফলন হয় ভালো।
বর্তমান সরকারের কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি ও সঠিক সহায়তার কারণে স্মরণকালের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল কৃষি খাতে। এদেশের কৃষকরা কঠোর পরিশ্রমী। আমাদের আছে উর্বর জমি ও কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি। এ তিনের সমন্বয়ে অচিরেই বাংলাদেশ আবার ভরে উঠবে ফসলের সমারোহে। নিশ্চিত হবে মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা।
সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)
নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লিমিটেড
netairoy18Ñyahoo.com