জলজ প্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী নিষিদ্ধ সাকার মাছের বিস্তাররোধ জরুরি

মো. জিল্লুর রহমান: কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে বিষাক্ত সাকার ফিশ ধরা পড়ার খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। শৌখিন অ্যাকুয়ারিয়ামের সাকার ফিশ (ঝঁপশবৎভরংয) নামে পরিচিত সাকার মাউথ ক্যাটফিশ (ঝঁপশবৎ গড়ঁঃয ঈধঃভরংয) বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ সারাদেশের নদনদী ও খালবিলে উদ্বেগজনকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিক ধাতু ক্যাডমিয়াম, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি এ মাছ এতটাই বিষাক্ত যে, এটিকে অন্যান্য মাছের খাদ্য কিংবা পোলট্রি ফিড তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার করা যায় না। যেসব পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে না পারলেও এটি পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। এ মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। এর দাঁতও বেশ ধারালো। এ মাছের কাঁটাযুক্ত পাখনা খুব ধারালো এবং এ পাখনার আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত তৈরি হয় এবং পরে পচন ধরে সেগুলো মারা যায়। এমনকি মানুষের দেহে কোনো রকম খোঁচা লাগলে বা বিদ্ধ হলে সেখানেও পচন ধরে এবং পচন শুকাতে অনেক সময় নেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদীর মোহনায় কম স্রোতযুক্ত স্থানে এ মাছগুলো সব সময় কিলবিল করে এবং প্রতিনিয়ত পানির ওপর থেকে অক্সিজেন গ্রহণের সময় এ মাছগুলো ব্যাপকহারে দৃষ্টিগোচর হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাশয়ে দেশি মাছের প্রাকৃতিক খাবার শ্যাওলা ও প্লাংকটন-জাতীয় খাদ্য খেয়ে সাকার মাছ বেঁচে থাকে। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দূষিত পানিতেও এ মাছ দ্রুত বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে এটি জলাশয়ে বেশি থাকলে প্রাকৃতিক খাদ্য দ্রুত কমে যাবে। এতে দেশি মাছের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং এজন্য মৎস্য বিশেষজ্ঞরা দেশের পুকুর কিংবা যে কোনো জলাশয় থেকে সাকার ফিশ নিধনের সুপারিশ করেছেন।

জানা গেছে, সাকার আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) থেকে অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ হিসেবে অ্যাকুয়ারিয়াম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম নিয়ে আসা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকাসটোমাস এবং ধারণা করা হয় কোনো শৌখিন অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে অসাবধানতাবশত নর্দমার মাধ্যমে মাছটি জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মাছটি অ্যাকুয়ারিয়ামে সৃষ্ট শ্যাওলা পরিষ্কার করে বলে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এ মাছ ময়লা খেয়ে অ্যাকুয়ারিয়াম পরিষ্কার রাখে। মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সাকার মাছ অবৈধভাবে দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এখন সারাদেশে এ মাছ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। দেশের অধিকাংশ জেলার নদ-নদীতে এ মাছ দেখা যাচ্ছে। এ মাছ বুড়িগঙ্গার মতো ব্যাপক দূষিত পানিতেও টিকে থাকতে পারে। মাছটি দ্রুত প্রজননও ঘটায়। পাশাপাশি মানুষ এই মাছ না খাওয়ায় এটি দ্রুত বাড়ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে। রাক্ষসে মাছের মতো সাকার দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে মাছের বংশবিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এ মাছটি দ্রুত বর্তমানে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জলাশয়েও ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ছে। এরা পুকুর, কম স্রোতযুক্ত অগভীর নদী, খাল ও বিলের তলদেশে বসবাস করে। এরা ঘোলা, দূষিত ও কম অক্সিজেনযুক্ত পানিতে বাঁচতে পারে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) একদল বিজ্ঞানী এ মাছের জীবনযাত্রা ও পুষ্টিগুণ নিয়ে গবেষণা করছেন। তাদের মতে, সাকার ফিশের শরীরে ভারী ধাতু কপার, জিংক, লেড, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে। এই মাছে প্রাপ্ত ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ ১.৭০ থেকে ১.৮৭ এমজি, যা মানবদেহে সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রার তুলনায় ১০০ গুণ বেশি। অন্যান্য ভারী ধাতু কপার, লেড ও ক্রোমিয়ামের পরিমাণ সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে কম। তবে জিংকের পরিমাণ সর্বোচ্চ সহনশীল মাত্রা ৫০ এমজির চেয়ে অনেক বেশি (৫৯.৭১ থেকে ৬৩.৬৭ এমজি) পাওয়া গেছে এ মাছে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাকার মাছ মানুষের খাদ্য হিসেবে পৃথিবীর কোথাও ব্যবহার করা হয় না এবং তারাও এটা খেতে কাউকে সুপারিশ করছেন না। কিন্তু নিষিদ্ধ এ মাছটি মফস্বলে অনেকে অজ্ঞতাবশত নির্দ্বিধায় খাচ্ছেও বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। স্থানীয়রা মাছটিকে ভিন্ন ভিন্ন নামেও চেনেন। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় বদ্ধ জলাশয়, পুকুর, ডোবা, খাল, বিল এমনকি সব সময় পানি থাকে এমন নর্দমায়ও সাকার ফিশের দেখা মিলছে। স্থানীয় জেলেদের কাছে এটি ‘আইড়বাইলা’ মাছ নামে পরিচিত। এ মাছের শরীরে আইড় মাছের মতো কালো ছোপ ছোপ দাগ আর শক্ত কাঁটা আছে। অনেকটা আবার বাইলা মাছের মতোই দেখা যায়। বাইলা মাছ মাটির সঙ্গে থাকে, এটিও পানির নিচে পাথর বা মাটির সঙ্গে লেগে থাকে। তাই স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছেন আইড়বাইলা।

সাকার ফিশের গবেষণা প্রসঙ্গে বিএফআরআইর একজন বিজ্ঞানী জানান, ‘এ মাছ নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা হওয়া দরকার। কয়েকটি উৎস থেকে মাছ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর উপাদান ক্যাডমিয়াম ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। মাছটি শিকারি মাছ নয়, বরং এরা চুষে খাবার সংগ্রহ করে খায়। হুমকি হচ্ছে, অন্যান্য মাছের সঙ্গে খাবার ও স্থান নিয়ে এরা প্রতিযোগিতা করে। মাছটির উৎপাদন ও বংশবৃদ্ধির হার বেশি। ফলে জলাশয়ে এদের আধিক্য থাকলে শ্যাওলা/পেরিফাইটন ও প্লাঙ্কটনজাতীয় খাবার প্রচুর পরিমাণে খাবে। এটি থাকলে আমাদের জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাদ্য দ্রুত কমে যাবে, যা অন্যান্য মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এজন্য দেশের পুকুর কিংবা যে কোনো জলাশয় থেকে সাকার ফিশ নিধন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, এ মাছ অন্যান্য মাছের খাদ্য কিংবা পোলট্রি ফিড তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার।

বিএফআরআই’র সুপারিশে এরই মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকর সাকার মাছ সম্প্রতি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। সম্প্রতি সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর মাছটি নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কেউ সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ, পরিবহন, বিক্রি, গ্রহণ বা প্রদান, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও মালিক হতে পারবে না। মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সাকার মাছ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করায় এখন চাইলে মানুষ এখন আর মাছটি আমদানি, অ্যাকুয়ারিয়ামে পালন বা বিক্রি কিংবা প্রজনন কিছুই করতে পারবে না। এ আইনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

জানা গেছে, বিএফআরআই এ মাছের বিস্তার রোধকল্পে প্রয়োজনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণের সুপারিশ করেছে। যেমন স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পুকুর প্রস্তুতির সময় ভালোভাবে শুকাতে হবে এবং সাকার মাছ সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে হবে। পুকুরে জাল টানার সময় ধরা পড়া সাকার ফিশ মেরে ফেলতে হবে। দেশে ইঁদুর নিধন অভিযানের মতো সাকার ফিশ নিধন অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে (টেলিভিশন, বেতার ও পত্রিকা) এই মাছের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ আমদানির ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সরকারের অনুমোদন ছাড়া অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ আমদানি এবং এর প্রজনন ও পোনা উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। সাকার ফিশের দেহে অঞ্চল/ঋতুভেদে হেভি মেটালের উপস্থিতি ও প্রজনন বিষয়ে নিবিড় গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন। বর্ষা মৌসুমে বদ্ধ জলাশয় থেকে নদ-নদীতে যাতে এ মাছ না যেতে পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হচ্ছেÑবদ্ধ জলাশয়ের মতো অভ্যন্তরীণ উš§ুক্ত জলাশয় (নদ-নদী, খাল, বিল) থেকে সেচে কিংবা জাল মেরে এ মাছ একেবারে অপসারণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ উš§ুক্ত জলাশয়ে সাকার মাছের প্রজনন রোধের জন্য কৌলিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ট্রিপলয়েড মাছ উৎপাদন অর্থাৎ তাদের বন্ধ্যাকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। উৎপাদিত এসব বন্ধ্যা মাছ পরে উš§ুক্ত জলাশয়ে ছেড়ে দিলে জলাশয়ে এরা  প্রজননের মাধ্যমে আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারবে না। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পাঁচ-ছয় বছর সময় প্রয়োজন হবে।

সাকার মাছ নিয়ন্ত্রণে মৎস্য অধিদপ্তর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গত বছরের ডিসেম্বরে কিছু নির্দেশনা দেয়। তাতে বলা হয়, দেশের উš§ুক্ত জলাশয়ে ও চাষের পুকুরে সাকার মাছ পাওয়া যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। মাছটি যাতে কোনোভাবেই উš§ুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। চাষ করা ও উš§ুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেলে, তা জলাশয়ে ছেড়ে না দিয়ে ধ্বংস করতে হবে। চাষ করা জলাশয় শুকিয়ে বা পুরোপুরি পানি সেঁচের মাধ্যমে সাকার মাছ ধরে তা মাটিচাপা দিতে বা বিনষ্ট করতে হবে। তাছাড়া শোভাবর্ধনকারী মাছ হিসেবে বাজারজাতকরণের জন্য হ্যাচারিতে প্রজনন বা লালনপালন বন্ধ করতে হবে। 

এ বিষয়ে জেলা-উপজেলাসহ সংশ্লিষ্ট স্থানে লিফলেট-পোস্টার বিতরণ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের জন্য অনুরোধ করা হয়। এছাড়া চলতি বছরের এপ্রিলে সরকার চিঠি দিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরকে বিএফআরআইয়ের মাধ্যমে দেশের জলাশয়ে সাকার মাছ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সাকার মাছ এখন জলজ প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্যের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এগুলোর প্রধান খাবার। সাকার অন্যান্য মাছের লার্ভা ও ডিম খেয়ে ফেলে। এর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দেশীয় মাছ টিকে থাকতে পারছে না। তাই যেকোনো উপায় নিষিদ্ধ এ বিষাক্ত মাছটির উৎপাদন, প্রজনন ও বিস্তার বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাংকার ও কলাম লেখক