মোতাহার হোসেন :রাজধানী ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। নতুবা ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত নগরীতে রূপ নেবে। সম্প্রতি এ ধরনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের সহযোগী সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৬৬তম। সবচেয়ে বসবাস-অযোগ্য তালিকায় শীর্ষে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক (১৭৩তম)। তাহার ওপরে রয়েছে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি (১৭২), আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স (১৭১), নাইজেরিয়ার লাগোস (১৭০) ও পাকিস্তানের করাচি (১৬৯) প্রভৃতি। এই তালিকা তৈরির নেপথ্যে পাঁচটি সূচক রয়েছে। সেইগুলো হচ্ছে, স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো। এ তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর ঢাকাকে বাসযোগ্য করার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলকে দ্রুতই উদ্যোগী হতে তাগিদ অনুভব করবেন। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর তালিকা অনুযায়ী শীর্ষ বাসযোগ্য শহর হচ্ছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। ভিয়েনার পর তালিকার শীর্ষদশে রয়েছে যথাক্রমে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন, সিডনি, কানাডার ভ্যানকুভার। ষষ্ঠ অবস্থানে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ, যৌথভাবে সপ্তম অবস্থানে আছে কানাডার ক্যালগেরি ও সুইজারল্যান্ডের জেনেভা। নবম অবস্থানে কানাডার টরন্টো এবং যৌথভাবে দশম অবস্থানে জাপানের ওসাকা ও নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। ওই সব শহরের সঙ্গে আমাদের রাজধানী শহর ঢাকা নগরীর কী তফাত রয়েছে; তাও আমাদের অনুধাবন করা দরকার। স্বাধীনতার পরপরই রাজধানী ঢাকাকে পরিকল্পিত বাসযোগ্য আধুনিক ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সাল থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত তিন বছরে নিয়েছিলেন নানা উন্নয়নমূলক জনহিতকর কাজের উদ্যোগ। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য রাজধানী গড়তে ঢাকাকে সাজাতে তিনি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি); যা বর্তমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে নানা দিক নির্দেশনামূলক কর্ম সম্পাদনের নির্দেশনা দেন। তার এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ডিআইটি কর্তৃপক্ষ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ শতাংশ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উš§ুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ শতাংশ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরোনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উš§ুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ । আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ শতাংশ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন। ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা এক কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়। রাজউক প্রণীত ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উš§ুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন। ঢাকাকে আধুনিকভাবে সাজাতে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবে বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশ সরকার। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ। এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। অবশ্য আধুনিক ঢাকা গড়া প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস সম্প্রতি এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, সিটি করপোরেশন থেকে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে এই প্রথম সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, একটি শহরের প্রাণ হচ্ছে পাড়া ও মহল্লাগুলো। সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়তে গেলে প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় আলাদাভাবে নজর দিতে হবে। এলাকাভিত্তিক সমস্যা শনাক্ত করে সেগুলোর স্থায়ী সমাধানের মধ্য দিয়ে এলাকার উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করাটা অত্যন্ত জরুরি। রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উš§ুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটির প্রায় ৮২ শতাংশ এলাকা কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। তাদের মতে পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উš§ুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ শতাংশ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ শতাংশ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উš§ুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ শতাংশের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না। নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, তা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট শতাংশ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উš§ুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের পরামর্শ হচ্ছে, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উš§ুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। অবশ্য ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে। এখন সে দিকেই সরকারকে নজর দিতে হবে। দেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মহাপরিকল্পনা তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মহাপরিকল্পনার নাম ড্যাপ। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। সুতরাং ঢাকাকে কীভাবে বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে তৈরি করা যায়, তার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা খুব কঠিন নয়। এ মহানগরীতে কত মানুষ বসবাস করার উপযুক্ত তারও একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকা প্রয়োজন। কারণ অধিক মানুষের চাপে যে কোনো ভালো পরিকল্পনা ও নাগরিক সুবিধা নষ্ট হতে বাধ্য। ঢাকাকে অধিক মানুষের বসবাস, আগমন কমাতে প্রয়োজন ঢাকার বাইরে প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মানুষের কর্মসংস্থান, উন্নত মানের স্বাস্থ্য সেবা, ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, যাতায়েত ব্যবস্থার উন্নয়ন বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস। কারণ কর্মসংস্থান, বিচারের আশায় ও অফিশিয়াল প্রয়োজনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখনও অধিকাংশ মানুষকে প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসতে হয়। পাশাপাশি ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলাগুলোয় শহর সম্প্রসারণ, কলকারখানা স্থাপন, ঢাকার বাইরে শিল্পনগরী, কলকারখানা, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, অবকাঠামোসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার বিবেচনায় প্রায় ১০ গুণেরও বেশি চাপ বহন করছে ঢাকা। এমনি অবস্থায় ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোকে দ্রুত উন্নয়ন, সম্প্রসারণ, অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলে ঢাকার জনসংখ্যা অন্তত এক-চতুর্থাংশে কমিয়ে আনা, অফিস, আদালত, কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যাংক বিমাসহ অন্যান্য কম গুরুত্বসম্পন্ন ভবন, স্থাপনা, যাত্রীবাহী যানবাহন কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। কারণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের গুরুত্ব, অবস্থান যতটা বাড়ছে; ঠিক ততটা গুরুত্ব রাজধানী ঢাকারও। এ বিবেচনায় দ্রুতই ঢাকাকে বাসযোগ্য ও আধুনিক নগরীর রূপ দিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের প্রত্যাশা।
পিআইডি নিবন্ধ