জিডিপি উন্নয়নের আদর্শ পরিমাপক নয়

রাতিক হাসান রাজীব : একটি শব্দের সঙ্গে মোটামুটি সবাই পরিচিতÑজিডিপি। জিডিপির পূর্ণরূপ হলো গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদন। জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি দেশের সীমানার মধ্যে উৎপাদিত সমস্ত সমাপ্ত পণ্য ও পরিষেবার আর্থিক মূল্য। অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহƒত হয় জিডিপি। জিডিপির মাধ্যমে একটি দেশের আর্থিক অবস্থা জানা গেলেও জিডিপি আমাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য কিংবা জনগণ কতটুকু সুখে তা জানতে দেয় না। এখনও অনেকে জিডিপি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার বিবেচনায় এনে একটি দেশের উন্নয়ন পরিমাপ করে, যা আসলে বোকামির সমতুল্য।

আইএমএফের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী এক. জিডিপি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পাদিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের হিসাব, যা সংবিধান ১৫২নং অনুচ্ছেদ অনুসারে ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন। (২) এর একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা আছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে উৎপাদিত পণ্য ও আগত হিসাবই জিডিপি। (৩) জিডিপি হলো পণ্য ও সেবার হিসাব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ প্রিয় ব্যান্ডের সিডি কিনে গান শুনলে, সে ক্ষেত্রে সেটি হবে জিডিপির অংশ; কিন্তু সে যদি একই ব্যান্ডের কনসার্ট শোনার জন্য পে করে; সেটি হবে পরিষেবা। (৪) জিডিপি কেবল ‘চূড়ান্ত’ পণ্য ও সেবার হিসাব করে। অন্তবর্তী কোনো পণ্যের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হবে না। (৫) জিডিপি ‘বাজারমূল্যে’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বর্তমান বাজারে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্য জিডিপির হিসাবভুক্ত হবে। (৬) জিডিপি ‘উৎপাদিত’ এর সম্পৃক্ত। উদাহরণস্বরুপ- যখন একটি উৎপাদন এবং বিক্রি করা হয়, সেটি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু পরে যদি গাড়িটি বিক্রি করা হয়, সেক্ষেত্রে এটি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হবে না।

একটি দেশের জিডিপি হিসাবের জন্য তিনটি গাণিতিক পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হল- (১) উৎপাদন পদ্ধতি, (২) আয় পদ্ধতি এবং (৩) ব্যয় পদ্ধতি। উৎপাদন পদ্ধতিতে জিডিপি পরিমাপ করার ক্ষেত্রে উৎপাদনকে তিনটি বৃহৎ ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো কৃষিকাজ থেকে উৎপাদন, সেবা হতে উৎপাদন এবং শিল্প হতে উৎপাদন। উৎপাদন পদ্ধতিতে জিডিপি নির্ণয়ের সমীকরণটি নিন্মরূপ-

জিডিপি= কৃষি উৎপাদন + শিল্প উৎপাদন + সেবা উৎপাদন + কর-ভর্তুকি

একটি দেশের পণ্য ও সেবা উৎপাদনে যেসব উপকরণ ব্যবহƒত হয়ে যেগুলোকে  ভূমি, শ্রম, মূলধন ও শিল্পোদ্যোগ এ চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যেখানে ভূমি হতে প্রাপ্ত ভাড়া, শ্রম হতে প্রাপ্ত মজুরি, মূলধন হতে প্রাপ্ত লাভ বা সুদ এবং শিল্পোদ্যোগ হতে প্রাপ্ত মুনাফার সমষ্টিই হলো নিট জাতীয় আয়। আয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে জিডিপির সমীকরণ-

জিডিপি = মজুরি + ভাড়া + সুদ + মুনাফা+ অবচয় + নিট বৈদেশিক উপাদান হতে আয় + পরোক্ষ কর – ভর্তুকি।

জিডিপি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহƒত পদ্ধতি হলো ব্যয় পদ্ধতি। ব্যয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে জিডিপির সমীকরণ হবে, , ‡DP= C+I+‡+(X-M); যেখানে উেচ= মোট দেশজ উৎপাদন, C= Consumption (ভোগ), ও= Investment (বিনিয়োগ), =‡= ‡overnment Expenditure (সরকারি ব্যয়) এবং (ঢ-গ)= নিট রপ্তানি।

আমরা জানি, জিএনপি জিডিপি থেকে ভিন্ন। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে, সাধারণ এক বছরে কোনো দেশের জনগণ মোট যে পরিমাণ চূড়ান্ত দ্রব্য বা সেবা উৎপাদন করে তার আর্থিকমূল্যকে জিএনপি বলে। জিডিপি হলো দেশের ভেতরে উৎপাদন আর জিএনপি হলো দেশের সব নাগরিকের এক অর্থবছরে আয়। অর্থাৎ সহজভাবে বলতে গেলে, জিডিপিতে দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত সব পণ্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত হবে; অন্যদিকে জিএনপিতে দেশের অন্তর্গত বসবাসকারী ও কর্মরত বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থার উৎপাদন বা আয় অন্তর্ভুক্ত না হলেও, বিদেশে অবস্থানরত দেশের নাগরিকদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার আর্থিক মূল্য অন্তর্ভুক্ত হবে।

বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের জিডিপি ও জিএনপি দুটোই বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। যদিও জিডিপি ও জিএনপি দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরতে অনেকেরই ঘোর আপত্তি রয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিনের মতে, ‘মানুষ তার যাপিত জীবন দিয়েই উন্নয়ন বুঝে।’ সত্যিকার অর্থে জিডিপির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটে না। এজন্য সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সাধারণ মানুষের জীবনমান সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত করার জন্য জিডিপি নির্ধারণের বর্তমান পদ্ধতি সংস্কার, প্রয়োজনে পরিবর্তন করা জরুরি। জিডিপি বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার দিয়ে একটি দেশের উন্নয়ন পরিমাপ করার অর্থনৈতিক যুক্তি ভীষণভাবে দুর্বল, যদিও আমাদের এ উপমহাদেশে এখনও এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাথাব্যথা।

জিডিপি নিয়ে ২০০৮ সালে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হয়। ফ্রান্সের তৎকালীন  প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি দু’জন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিৎজ এবং অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ জাঁ পল ফিটুসিকে দায়িত্ব দেন, জিডিপি ভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিমাপের সমস্যা এবং এর বিকল্প নিয়ে প্রস্তাব দেয়। যার ফলাফল ২০১০ সালে গরংসবধংঁৎরহম ঙঁৎ খরাবং; ডযু উেচ উড়বংহ’ঃ অফফ টঢ় শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটির শিরোনামের মাধ্যমে স্পষ্ট যে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে করা অর্থনৈতিক পরিমাপ করার সনাতন পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষের সত্যিকারে ভালো থাকার পরিমাপ না; বিকল্প পদ্ধতি জরুরি। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে এখনও এ পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়, যার ফলে প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে না।

জিডিপিতে আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্বীকৃতি দিলেও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির অনেক কিছুকে উপেক্ষা করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে এবং নারীরা পরিবারের জন্য যেসব কাজ করে, তার আর্থিকমূল্য জিডিপিতে যুক্ত হয় না। জিডিপিতে সেই সব কাজ ও ভোগ গণনা করা হয়, যার সঙ্গে অর্থ সংশ্লিষ্ট থাকে। জিডিপি গণনা ক্ষেত্রে গৃহস্থালি কাজ, পানি ও জ্বালানি সংগ্রহ, পরিবারের সদস্যের পারিবারিক উদ্যোগের কাজ বা মাঠে কাজ করা এবং অন্যের যতœ নেয়াকে উপেক্ষা করা হয়। এ ধরনের কার্যাবলি তখনই গণনা করা হয়, যখন তারা মজুরির বিনিময়ে এসব করে থাকে। যেমনÑকোনো রাধুঁনী যদি রেস্টুরেন্টের জন্য রান্না করে সেটি জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হলেও, সে যদি সেই একই খাবার তার পরিবারের জন্য রান্না করে তাহলে তা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। বৈশ্বিকভাবে বেশিরভাগ নারীদের একক পেশা থাকে না, ফলে তাদের বেশিরভাগ কাজ জিডিপিতে যুক্ত হয় না। ফলে নারীরা অর্থনৈতিক অবদানে অক্ষমÑ এ ভাব প্রকাশ পায়। যার ফলে একটি দেশের উন্নয়নের চিত্র জিডিপির মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয় না।

অনেকগুলা সীমাবদ্ধতার কারণে জিডিপিকে উন্নয়নের আদর্শ পরিমাপক হিসেবে গণ্য করা হয়, ফলে বর্তমানে আরও কিছু নির্দেশকের কথা উঠে আসছে যার মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন পরিমাপ করা সম্ভব। এর মধ্যে কিছু হলো: (১) মানব উন্নয়ন সূচক (ঐঁসধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ওহফবী ড়ৎ ঐউও) –  টঘউচ প্রবর্তিত ঐউও হলো উন্নয়ন পরিমাপের নতুন পথ, যা প্রত্যাশিত আয়ু, শিক্ষাগত অনুপ্রবেশ এবং আয়ের নির্দেশকগুলোকে সমন্বিত করে একটি যৌগিক মানব উন্নয়ন সূচকে পরিণত হয়েছে। (২) বিশুদ্ধ উন্নতি নির্দেশক (বেহঁরহব চৎড়মৎবংং ওহফরপধঃড়ৎ)-জাতীয় গণনায় ভালোকে খারাপ থেকে পৃথক করার জন্য বিশুদ্ধ উন্নয়ন নির্দেশক একটি অনুরূপ প্রচেষ্টা চেও, যেটি ১৯৯৫ সালে প্রস্তাবিত হয়েছিল উন্নতিকে পুনঃসংজ্ঞায়নের মাধ্যমে। জিপিআই, এইচডিআই’র তুলনায় অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিমাপক,  কারণ এটি মাত্র তিনটি নির্দেশককে সমন্বিত করে না বরং তিনটির ক্ষেত্রে ২৬টি নির্দেশককে সমন্বিত করে। (৩) মোট জাতীয় সুখ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস)-সম্ভবত সর্বাপেক্ষা ব্যাপক ও আশাপ্রদ একটি রূপরেখা, যা জিডিপি থেকে অনেক দূরের একটি পদক্ষেপ নিতে পারে তা হলো জিএনএইচ। এটি মানুষ কি উৎপাদন করে তার পরিবর্তে মানুষ কী মূল্য দেয় সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ‘সুখ’ মানে সচ্ছলতা বা ভালো থাকা বোঝায়। এর আদি উৎস পাহাড়ি রাজ্য ভুটান। নির্দিষ্টভাবে সর্বমোট ৯টি ক্ষেত্র বা স্বম্ভের দিকে লক্ষ করে। এসব ক্ষেত্রে আবার ৩৩টি নির্দেশক রয়েছে।

সর্বোপরি, জিডিপি এমন একটি সূচক, যার মাধ্যমে একটি দেশের আর্থিক অবস্থা জানা গেলেও একটি দেশে কতটা উন্নত তা পরিমাপ করা সঠিক হবে না।

শিক্ষার্থী

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট