স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ডেঙ্গু প্রতিরোধ জরুরি

. . . মাছুম বিল্লাহ ভূঞা : বাংলাদেশের মানুষ একটা জাতীয় মহাদুর্যোগের মুখোমুখি। এই মহাদুর্যোগের কারণ ডেঙ্গু মহামারি। কভিড মহামারির মতো যা বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কফিনে শেষ পেরেক ঢুুকিয়ে দিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের মৃত্যুর স্কোর। তাই অতীতের বিশ্বযুদ্ধ কভিডের মতো ডেঙ্গু দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। ডেঙ্গু মশার প্রজনন বিস্তার মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও এবার রাজধানীর বাইরেও মারাত্মক আকার নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের জেলা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বিভাগ এবং নদীবেষ্টিত বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আর এতে করে ডেঙ্গুতে এবার বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক বছর আগে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় প্রাথমিক সংক্রমণ ঘটলেও মশা নিধনে যৌক্তিক ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে ডেঙ্গু সেখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

একসময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে সারা বছর জুড়ে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এই রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে ঢাকার সবগুলো সরকারি হাসপাতালে ধারণক্ষমতার বেশি ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও এখন প্রতিদিন যত রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত। ডেঙ্গুতে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে প্রতিটি প্রাণ। দেশে নানামুখী প্রশ্ন তর্ক থাকলেও ডেঙ্গু চিকিৎসা মোকাবিলায় চিকিৎসকস্বাস্থ্যকর্মীরা জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করছে। কিন্তু মশকনিধনের নানা প্রক্রিয়া তৎপরতা নিয়ে বাহাস চলছে। সবাই একমত যে, চলমান ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় দরকার এক সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কর্মকৌশল। পরিবেশব্যবস্থায় সুস্থতা না থাকার কারণে ম্যালেরিয়ার চিকুনগুনিয়া পর ডেঙ্গু একের পর এক দুঃসহ যন্ত্রণা প্রকট হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনার বছর ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত, তখন ২৩ জেলায় ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। সেখানে একই সময়ে চলতি বছর ৬৪ জেলায় ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকায়। এমনকি এক মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮টি জেলায়। আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ কয়েকগুণ বেশি। হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর চারজনের মধ্যে একজনই শিশু। অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক আগেই এসেছে এবং সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে; ফলে এটা প্রাদুর্ভাব থেকে মহামারির দিকে চলে গেছে। এজন্য এখন দেশে একটা জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। অবস্থায় দেশেস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থাঘোষণা করা দরকার।  

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, গত সাড়ে ছয় মাসে মৃত্যু হয়েছে ১৪৬ জনের। এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ,৭৯২ জন। এর আগে দেশে বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু হয়নি। গত এক দশকের মধ্যে বছরের জুলাই মাসে দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এই রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরও সেদিকে দৃষ্টি না দেয়ায় এই বছরে ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে উঠছে। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে সাধারণত বাংলাদেশে ডেঙ্গুর পিক সিজন ধরা হয়। ২০২২ সালে দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী মারা যায়, তখন মোট ৬২ হাজার ৯৮ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল এবং ২৮১ জন মারা গিয়েছিল। ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর বার্ষিক হারের হিসাবে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় এবং জুলাই মাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল, যার সংখ্যাটি ছিল ১৬ হাজার ২৫৩ জন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। তবে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। ছাড়া ২০২০ সালে জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা যান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত তথ্য আসছে না। কারণ যারা আক্রান্ত হয়ে ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, এমনকি সব বেসরকারি হাসপাতালের তাদের তথ্য এখানে যুক্ত হয় না।

৩১ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৩৬ জন শিশু এবং তাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। তবে বছর ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সী মানুষের বেশি মৃত্যু হচ্ছে। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। আক্রান্তদের তালিকায় রয়েছে একেবারে শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠরাও।

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ২০০০ সালের আগে মানুষ ডেঙ্গুর একটা ধরনে আক্রান্ত হতো। ফলে তাদের মধ্যে একটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠত। কিন্তু যখন মানুষ ডেঙ্গুর চারটা ধরনেই আক্রান্ত হতে শুরু করে, তখন সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেড়ে যায়, তখন প্রতিরোধ ক্ষমতা তেমন কাজ করে না। ২০১৭ সালেবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাএডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারকে যে পরিকল্পনা দিয়েছিলেন, সেটি সরকার আমলে নেয়া হয়নি বলেই দুই বছর পর থেকে ডেঙ্গু জ্বরের বড় ধাক্কা দেখতে হচ্ছে এবং এই মহাদুর্যোগ আমাদের জাতীয় জীবনের সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলছে। সেই পরিকল্পনায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কোন মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা দায়িত্ব পালন করবে, তাও সংক্ষিপ্ত আকারে বলা হয়েছিল। এডিস মশা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত সরকারের তেমন দৃশ্যমান কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। তাই বর্তমানে ডেঙ্গু আর বড় শহরগুলোয় সীমাবদ্ধ নেই। জেলাউপজেলার মফস্বল শহরগুলোয় পর্যন্ত ছড়িয়ে মৃত্যুর রেকর্ডও হয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ডেঙ্গুতে এবার বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।

ডেঙ্গু মহামারির কারণে পুরো দেশ আজ থমকে আছে। ডেঙ্গুর দৈত্যকে যখন বোতল হতে বের হচ্ছিল তখন সরকার অর্থাৎ স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বোতলের মুখ আটকে তাকে বন্দি করে রাখতে পারিনি। কোনো মহাদুর্যোগের পূর্বে জাতির কঠিনতম সময়ে সরকারের যেরকম নিদ্রাহীন, আহারহীনভাবে দিনরাত প্রস্তুতির কথা থাকে; সেটা দেখা যায় নাই। মহাপ্লাবন আসছে, বাঁধ রক্ষার যে শপথ চায়, যোগ্য নেতৃত্বে অভাবে সে শপথের ডাক আসে নাই। ডেঙ্গুর সংক্রমণ যদি অন্যান্য মহাদুর্যোগের মতো পরিণত না হয়, তাহলেও আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু প্রস্তুতি না নেয়ার কোনো সুযোগ আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু দুঃখের বিষয় যথাসময়ে আমরা প্রস্তুতি গ্রহণে অনীহা দেখিয়েছি। যার ফলে ডেঙ্গুর দৈত্য বোতল থেকে বের হয়ে গেছে। এই দৈত্য দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে তছনছ করবে; স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে খাবে, সঙ্গে বাংলাদেশকেও। কারণ দিন দিন মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মানুষ আর্থিক বিপর্যয়ে পড়ছে। অপরদিকে, জিডিপির হিসাবে স্বাস্থ্যে খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ কমেছে। মোট বরাদ্দের নিরিখে ২০২২২৩ অর্থবছরে স্বাস্থ্য চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের দশমিক শতাংশ। এবার মোট বাজেটের নিরিখে স্বাস্থ্য চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ দশমিক শতাংশ কমেছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট প্রতিবেদন তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে চিকিৎসার পেছনে মানুষের যে খরচ তার ৬৯ শতাংশই ব্যক্তি নিজেই বহন করেন। আর চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর ৮৬ লাখেরও বেশি মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছেন। সরকারের হিসাবেই চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ার এবং অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না। হিসাবে প্রায় তিন কোটি মানুষ প্রয়োজন হলেও চিকিৎসা নিচ্ছে না।  দেশে ডেঙ্গু বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পেছনে জলবায়ু বিপর্যয়কে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে এডিস মশা বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ পেয়েই বাড়ছে। ফলে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুর বাহক এডিস মশার বিস্তার সারাদেশে। গত দুই বছরের চেয়েও বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন তথ্য বলছে, আর্দ্রতা কমে আসার পাশাপাশি তাপমাত্রা বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে ঋতুভেদে আবহাওয়ার বৈচিত্র্য। এই রোগে প্রতি বছর যতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয় তার ২৫ শতাংশ হয় বর্ষাকালে। আর শীতকালে হয় ১৪ শতাংশ। 

২০২৩ মৌসুমে সর্বোচ্চ এবং বিগত ৫৮ বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা যখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, দেশের হাসপাতলগুলো রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার থেকে দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে ৮০ শতাংশ রোগী। বাকি ১৪ শতাংশ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং শতাংশ ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে। ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত মৃত ৫০ জন রোগীর মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া যায়। আর ২০২২ সালে হাসপাতালে রোগী ভর্তির দিনের মধ্যে ডেঙ্গুতে ৬৪ শতাংশ মৃত্যু হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে মৃত ৫০ জনের মধ্যে ৬২ শতাংশ নারী আর পুরুষ ৩৮ শতাংশ। মৃতদের ৬০ দশমিক ৮০ শতাংশের বয়স ১৯ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। ছাড়া শতাংশ মৃত্যু ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে। সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ২০২৩ সালের এই সময়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে ১০ গুণ, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন প্রয়োজন হচ্ছে, মাস শেষে তা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১২ লাখ ব্যাগ।

যদিও সেই মুহূর্তে জাতি সব সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসে নাই, আমাদের নিজ নিজ উদ্যোগে কোনো বিবেচনায়ই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিলম্ব করা উচিত হয়নি। বহু বছর আগে হাবীবুল্লাহ বাহার যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি এই ঢাকা শহরে মশার বংশ ধ্বংস করেছিলেন, যা আজও প্রবাদ হয়ে আছে। সে সময় প্রযুক্তিও এত উন্নত ছিল না। তারপরও তিনি ঢাকা শহরকে মশকমুক্ত করেছিলেন। আজ উন্নত প্রযুক্তি প্রতিষেধক থাকা সত্ত্বেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ পারছে না কেন? ডেঙ্গু এমন রোগ নয় যে এটি প্রতিরোধ করা যায় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যা করেছে, সেটি হলো আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, তবে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের কাজ হওয়া উচিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, চিকিৎসাসেবা নয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কেমন হতে পারে, তার একটা দুর্দান্ত দৃষ্টান্ত হলো সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (এনইএ) কর্মীরা নিয়মিত মানুষের ঘরে ঘরে এবং এলাকায় এলাকায় গিয়ে পাবলিক স্পেস, কনস্ট্রাকশন সাইট এবং হাউজিং এস্টেটে এডিস মশার š§স্থল খুঁজে ধ্বংস করে থাকে। সিঙ্গাপুরের আইন অনুসারে নির্মাণকাজের সময় কনস্ট্রাক্টরদের পেস্ট কন্ট্রোল অফিসার পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দিতে হয় যাদের কাজ হলো প্রতিদিন সকালে মেঝে পরিষ্কার করা এবং দুই সপ্তাহে একবার মশকরোধী তেল প্রয়োগ করা যেন এসব সাইটে জমা পানিতে মশা š§াতে না পারে, বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে মশার লার্ভা মারা যায়। পরিদর্শন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কনস্ট্রাকশন সাইটের মতো সম্ভাব্য বিপজ্জনক স্থানের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এনইএ প্রতি মাসে অন্তত একবার কনস্ট্রাকশন সাইটগুলো পরিদর্শন করে, আইন ভঙ্গ করলে জরিমানা করা হয় এমনকি সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ করেও দেয়া হয়।

কিন্তু আমরা ডেঙ্গু রোগের উৎস এডিস মশার š§ ঠেকাতে পারলাম না কেন? রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতির কারণে এই রোগের সংক্রমণের বিপুল প্লাবনকে বাঁধ দিয়ে সিঙ্গাপুর কলকাতার মতো ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার চেয়ে জরুরি হলো এডিস মশার উৎস নির্মূল করা। সেটি করতে পারলে হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে এত পেরেশান হতে হবে না, তখন সিটি করপোরেশনকেও মশা মারতে কামান দাগতে হবে না। সিঙ্গাপুর সরকার কলকাতা সিটি করপোরেশন জনগণের মাঝে ডেঙ্গু নিয়ে যেরকম কার্যক্রম শুরু করেছে, বাংলাদেশ সরকার এরকম কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তখন এই জোয়ারের ঠেলায় সবকিছু ভেসে জেতে পারত না। যারা কাজে গাফিলতি করে ভীষণ বিপদে পড়ছেÑতারা হলো রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম বরিশাল বিভাগ। এখন তাদের অবস্থা সামালের বাইরে। তাই পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা হয়ে উঠেছে মশাবাহিত এই রোগ। এজন্য ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশনগুলোকে তুলাধোনা করছে মানুষ। 

এবার এটা কোনো স্থানীয় সুর্যোগ নয়। দেশব্যাপী এবং সকল মানুষের দুর্যোগ। মানুষকে বাঁচানোর পরিস্থিতি ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। আমরা নিজেকে বাঁচানোর, নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের বাঁচানোর, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীদের বাঁচানোর প্রতি কি আমরা এতই অনাগ্রহী? যদি আগ্রহী হতাম, তাহলে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ জায়গা থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে উদ্যোগী হতাম। এই অবস্থানের উত্তম বিকল্প ছিল না। প্রত্যেকে বসতবাড়ি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন রাখা। কোনোভাবেই ফুলের টব অন্যান্য স্থানে বৃষ্টির পানি জমতে না দেয়া, যা আরও আগেই করা উচিত ছিল। কারণ এডিস মশা যে শুধু ফুলের টবে কিংবা ছাদে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতেই š§, তা নয়। বিভিন্ন পাবলিক প্লেস এবং বিশেষত সরকারিবেসরকারি নির্মাণাধীন ভবন স্থাপনায় পড়ে থাকা বোতল, প্যাকেট, ডাবের খোসা, কনটেইনার, ড্রাম, ব্যারেল, পরিত্যক্ত টায়ার, ইটের গর্ত ইত্যাদিতে জমে থাকা পানিতে š§াতে পারে।

যদি আমরা পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতাম, তাহলে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারতাম কিন্তু তা করিনি। কিন্তু এটা সত্য, দিকনির্দেশনার অভাবে করা সম্ভব হয়নি। তারপরও আমাদের কী কাজ করতে হবে, গণমাধ্যমের বরাতে সেটা পরে হলেও আমরা জানতে পারছি। শুরুতে আমাদের কাজ ছিল, এলাকার সকল মানুষ একত্র হয়ে এডিস মশা প্রতিরোধে উৎসাহিত করা। এই দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এলাকার মানুষকে প্রস্তুত করা। যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে স্বাস্থ্য উন্নয়ন করা, আর যারা আক্রান্ত হয়নি, তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ডেঙ্গুতে এবার বেসামাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবই মশা বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই মানুষকে সচেতন আচরণ করতে হবে, নিজের বাড়ি ভবন অফিসের ছাদে জমা পানি না থাকে এজন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন রাখা এবং এডিস মশা না থাকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

  আইনজীবী