এক্সচেঞ্জ হাউসে আসে রেমিট্যান্স রপ্তানি না করেই নেয় প্রণোদনা

রহমত রহমান : রপ্তানি হওয়ার কথা মরিচ, হলুদ, জিরা ও মসলার গুঁড়া। বাস্তবে রপ্তানি হয়নি। কিন্তু রপ্তানির কাগজপত্র বলছে, পণ্য রপ্তানি হয়ে গেছে। সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া থেকে রপ্তানির টাকা দেশে চলে এসেছে। পণ্য রপ্তানি হয়েছে, টাকা দেশে এসেছেÑএমন কাগজ দেখিয়ে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা নিয়েছে প্রতিষ্ঠান। অথচ রপ্তানি থেকে নগদ সহায়তা নেয়া পর্যন্ত প্রতি ধাপেই ছিল জালিয়াতি। রপ্তানির নামে এমন জালিয়াতি করেছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এমটি এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস। প্রতিষ্ঠান বলছে, অফডক দিয়ে রপ্তানি হয়েছে। অথচ অফডক কর্তৃপক্ষ জানে না। যে শিপিং এজেন্টের নাম দেয়া হয়েছে, তা ভুয়া।

যে প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানি দেখানো হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান এই ধরনের পণ্য আমদানি করে না। রপ্তানির টাকা রেমিট্যান্স হাউসের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছে, যা আইনত নিষিদ্ধ। নগদ সহায়তা নিতে প্রতিষ্ঠান ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করেছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের তিন পরিচালক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের ছয়সহ নয়জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা। তদন্ত শেষ হয়েছে, প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবে তদন্তকারী কর্মকর্তা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এনবিআরকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেয়। যাতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর এনবিআর কাস্টমস গোয়েন্দাকে একটি প্রতিবেদন দেয়, যা ছিল বিএফআইইউর গোয়েন্দা প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ঢাকার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এমটি এগ্রো ফুড প্রোডাক্টস। দক্ষিণ রায়েরবাগ, মুজাহিদ নগর, কদমতলী এলাকায় প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি। প্রতিষ্ঠানটি ফুড স্টাফ যেমন হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, আদার গুঁড়া, ধনিয়ার গুঁড়া রপ্তানি করেছে। কিন্তু রপ্তানির অর্থ প্রত্যাবাসন না করে পাচার করেছে। এছাড়া রেমিট্যান্স হাউসের মাধ্যমে দেশে আনা রেমিট্যান্সকে রপ্তানি মূল্য দেখিয়ে নগদ সহায়তার অর্থ আত্মসাৎ করেছে। অভিযোগটি অনুসন্ধান করে সত্যতা পেয়ে এনবিআরকে একটি প্রতিবেদন দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমটি এগ্রোর রপ্তানির ২৬টি বিল অব এক্সপোর্ট এবং ব্যাংক হতে বিল অব লেডিংয়ের তথ্য যাচাই করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রামের তিনটি অফডকের মাধ্যমে ২৬টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে কনটেইনারে করে পণ্য রপ্তানি করেছে বলে দাবি করেছে। তিনটি অফডক হলোÑসীতাকুণ্ডের কেডিএস লজিস্টিক লি., বন্দর এলাকার ইছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লি. ও দক্ষিণ পতেঙ্গার এসএপিএল। রপ্তানির বিষয় নিশ্চিত হতে অফডক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ জানায়, সংশ্লিষ্ট বিল অব এক্সপোর্ট নাম্বারের বিপরীতে কোনো পণ্য রপ্তানি

হয়নি। এতে প্রমাণিত হয়, রপ্তানিকারক কোনো পণ্য রপ্তানি করেনি। জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা রপ্তানি বিল ব্যাংকে জমা দিয়ে নগদ সহায়তা হাতিয়ে নিয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক হতে নেয়া বিল অব লেডিং ও বিল অব এক্সপোর্ট যাচাইয়ে দেখা গেছে, রপ্তানিকারকের পণ্য চারটি শিপিং এজেন্টের মাধ্যমে জাহাজীকরণ হয়েছে। চারটি শিপিং এজেন্ট হলোÑওশান ফ্রেইট সিস্টেম, ওশান ফ্রেইট সিস্টেম লি., গ্রিনভিউ লজিস্টিক লি. ও কোরিয়া মেরিন ট্রান্সপোর্ট কোং। চিঠি দেয়া হলে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন জানায়, চারটি শিপিং এজেন্ট তাদের সদস্য নয়। ফলে এদের বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। যাচাইয়ে দেখা গেছে, এই নামে কোনো শিপিং এজেন্ট নেই। এতে প্রমাণিত হয়, রপ্তানিকারক ভুয়া শিপিং এজেন্টের নাম ব্যবহার করে ভুয়া রপ্তানি বিল অব লেডিং তৈরি করেছেন।

আরও বলা হয়, এমটি এগ্রোর রপ্তানির বিপরীতে নেয়া নগদ সহায়তার বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) আপত্তি দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরতের উদ্দেশ্যে এমটি এগ্রোর হিসাব (অ্যাকাউন্ট) হতে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর দুই কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে বিধিবহির্ভূতভাবে নেয়া নগদ সহায়তার ছয় কোটি ১০ লাখ ৮৪২ টাকা প্রতিষ্ঠানের উত্তরা ব্যাংকের হিসাব থেকে ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সরকারি হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এতে প্রমাণিত হয়, রপ্তানিকারক জালিয়াতি করে সুপরিকল্পিতভাবে নগদ সহায়তার টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি না করে জাল রপ্তানির দলিল ব্যাংকে দেখিয়েছে। এর মাধ্যমে তৃতীয় দেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স দেশে এনেছে। যাকে রপ্তানির মূল্য প্রত্যাবাসন দেখিয়েছে। প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে মুদ্রা পাচার করেছে দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এনেছে। প্রতিষ্ঠান জাল বিল অব লেডিং, শিপিং এজেন্ট বিল তৈরি করে নগদ সহায়তা গ্রহণ করেছে। জালিয়াতি, দেশি ও বিদেশি মুদ্রার পাচার, শুল্ককর ফাঁকির মতো অপরাধ করেছে প্রতিষ্ঠান। এতে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী অপরাধ। এতে জড়িত এমটি এগ্রোর পরিচালক তাজুল ইসলাম টিপু, মোস্তফা কামাল, আলমগীর হোসেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট রিলাইয়েবলের স্বত্ব¡াধিকারী আবু বক্কর ছিদ্দিকী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কেএইচএল এক্সিম লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইব্রাহীম হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল ইসলাম রাসেল, পরিচালক জাকির হোসেন, নাফিজ ইকবাল ও বদরুল ইসলাম।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এনবিআর মামলার অনুমতি দিয়ে কাস্টমস গোয়েন্দাকে চিঠি দেয়। ১৫ মে মতিঝিল মডেল থানায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জামিউল হক মামলা দায়ের করেন। তদন্ত ও সাক্ষ্য শেষে রাজস্ব কর্মকর্তা আহছান উল্লাহ চলতি বছরের ৩১ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এই প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপনের অনুমতি দেয়ার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমটি এগ্রো ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির জন্য এসব দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৪৪টি রপ্তানি করে। চুক্তি হলেও কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। কিন্তু ছয়টি বিল অব এক্সপোর্টের মাধ্যমে এই পণ্য রপ্তানি হয়েছে দেখায় এমটি এগ্রো। এমটি এগ্রো নিজেই সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন রেমিট্যান্স হাউসের মাধ্যমে রপ্তানি পণ্য মূল্য হিসেবে ১৪ লাখ ৩১ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এ রপ্তানির বিপরীতে বিধিবহির্ভূতভাবে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের তিন পরিচালক এই নগদ সহায়তা নিয়েছেন। তাদের সহযোগিতা করেছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও শিপিং এজেন্ট। চলতি বছরের ৩০ মে তদন্ত কর্মকর্তারা ফ্যাক্টরিতে গেলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

রপ্তানিতে জালিয়াতির বিষয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানায়, সকল প্রয়োজনীয় ও বৈধ কাগজ দিয়েই রপ্তানি করেই নগদ সহায়তা নেয়া হয়েছে। এরপরও মানি লন্ডারিং মামলা করা যুক্তিসঙ্গত ও আইনসিদ্ধ নয়। রপ্তানি-সংক্রান্ত সকল কাগজ ব্যাংকে রয়েছে।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দুটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করেছে। তারা বলেছে, রপ্তানিতে তারা শুধু নোটিং করেছে। বাকি কাজ রপ্তানিকারক করেছে। ব্যাংক থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি-সংক্রান্ত কাগজের সঙ্গে মালামাল পরিবহনে ট্রাক বা রেলের কোনো চালান নেই। রপ্তানি মূল্য একচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে হলে নগদ সহায়তা পাওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইড লাইন অনুযায়ী, ব্যক্তি ছাড়া কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবে না। তবে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি বলে জানানো হয়েছে। রপ্তানিকারক বিদেশে যেসব প্রতিষ্ঠানে পণ্য রপ্তানি করেছে বলে কাগজপত্রে দেখিয়েছে, আদতে এসব প্রতিষ্ঠান এই ধরনের পণ্য আমদানি করে না বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।