ড্যাপ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নীতিনির্ধারকদের সমন্বয় জরুরি

মো. মিঠুন: ঢাকা শহর নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আমরা হরহামেশাই শহর নিয়ে নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেখেছি কিন্তু এর বেশির ভাগ উন্নয়নকে আজও জনবান্ধব করা সম্ভব হয়নি। আমরা দেখেছি, নগর উন্নয়ন মানেই শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। ভুলে গেলে চলবে না যে, সৌন্দর্যবর্ধন আর অবকাঠামো উন্নয়ন এক জিনিস নয়। শুধু সৌন্দর্যবর্ধনকল্পে অনেক অর্থের অপচয়। যেখানে নেই কোনো মানুষের অংশগ্রহণ, অথচ প্রতিটি উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ জাদের জন্য উন্নয়ন করা হচ্ছে আদও কি তারা এর সুফল ভোগ করতে পারছে কি সাধারণ মানুষ। তা নিয়ে পরিকল্পনাকারীদের তেমন একটা মাথাব্যথাই নেই। যেমন পথচারীদের সড়ক পারাপারের জন্য অধিক অর্থ ব্যয় করে ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করলেন, সেখানে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী ও শিশুর কথা আমরা কি একবারও চিন্তা করেছি যে এরা ৩০ ফুট উঁচু ব্রিজ কী করে পাড় হবে। যেখানে একটি জেব্রা ক্রসিং একে দিয়ে পথচারীদের চলাচলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা গেলে অযথা অর্থ অপচয় কমে আসত, পাশাপাশি এই মানুষগুলোর জন্য শহরাটা আরও ব্যবহার উপযোগী হয়ে উঠত। আরও একটি বিষয় খেয়াল করলে দেখা যায়, যিনি এসি রুমে অফিস করেন তিনিই নগর উন্নয়নের নামে নির্বিচারে গাছ কর্তন করে নগর উন্নয়ন দেখাচ্ছে। যে ব্যক্তি কর্মজীবনে রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে না তিনিই যানজট নিরসনে অযাচিত ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে চলছেন। আবার যার শিশুসন্তান কখনোই খোলা উš§ুক্ত গণপরিসরে খেলাধুলা করে না তারা তাদের কর্মপরিকল্পনায় মাঠ-পার্কগুলোকে খাঁচাবন্ধি করে ফেলছে। আমরা কেবল প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়নের দিকে ঝুঁকছি কিন্তু মানুষ আর না মানুষের জন্য শহরকে আজও সঠিক অর্থে তৈরি করতে পারিনি। না মানুষ বলতে আমরা শহর উন্নয়নে যেমন মানুষকে ভিত্তি করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছি, ঠিক তেমনি করে নামানুষের মধ্যে আছে পশু, পাখি, নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী, পোকা-মাকড় তাদের কথাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এরাও আমাদের প্রকৃতির অংশ। ২০২২ সালের ২৩ আগস্টে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ঢাকা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ২০২২-২০৩৫ গেজেট আকারে জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়। দিনটি ছিল নগরবাসীর জন্য অত্যন্ত খুশির এবং আনন্দের। আরও আনন্দের বিষয় এই যে পুরো কর্মপরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ বাংলায় প্রকাশের ফলে তা জনসাধারণের জন্য বুঝতে আরও সহজ হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষও যেন খুব সহজে বুঝতে পারে পরিকল্পনাটিতে কী রয়েছে; যা অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার। এখন যে কেউ চাইলেই ঢাকাকে নিয়ে এত বড় এই কর্ম পরিকল্পনাটি বাংলায় পড়তে পারবে এবং এ বিষয়ে নিজের মতামত ও চাহিদাগুলো প্রকাশ করতে পাড়বে। অনেক দেরিতে হলেও এটিকে যে পূর্ণাঙ্গ আকারে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে তাতেই মানুষ অনেক খুশি হয়েছে; কারণ প্রতিনিয়ত যে ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে তার মধ্যে ঢাকা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) একটু স্বস্তির সুবাতাস দিতে পেরেছে। তবে শুরুটা যেমন আশার আলো ছড়িয়েছে ঠিক এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে এর সুফল নগরবাসী কবে নাগাত পেতে পারে তা কারোর জানা নেই।

১৯৫৯ সালে প্রস্তুতকৃত প্রথম মহাপরিকল্পনা ছিল মূলত একটি স্থির রূপকল্পভিত্তিক  (ঊহফ-ঝঃধঃব) নগর পরিকল্পনা। এ ধরনের পরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী অপ্রাসঙ্গিক বা বিবর্তিত সময়ের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হওয়ায় নগর পরিকল্পনার ধারণা পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে কৌশলগত পরিকল্পনার দিকে আগাচ্ছিল। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ঢাকার জন্য তিন স্তরবিশিষ্ট পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই পরিকল্পনাটির নাম তখন দেয়া হয়েছিল ‘ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা’। এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় এবং ঊর্ধ্বতন স্তরের নীতি নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১০ সালে প্রথম বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। যার মেয়াদ ২০১৫ সালে সমাপ্ত হয়েছিল। পরে ২০১৬-২০৩৫ সালের জন্য ঢাকা শহরের ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ড্যাপ চূড়ান্ত করা হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা এক গ্যাজেট প্রজ্ঞাপনে এ রূপরেখা চূড়ান্তও করা হয়। ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করার জন্য ড্যাপ একটি অন্যতম সমাধান হিসেবে আমাদের সামনে হাজির করা হয়। নগর জীবন রেখার আলোকে ৫৭৪ কিলোমিটার জনপদকে নতুন করে ঢাকাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয় নতুন ড্যাপে। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে খেলার মাঠসহ স্কুল নির্মাণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে আঞ্চলিক পার্ক করার কথাও ড্যাপে উল্লেখ করা হয়। ঢাকার মানুষের মাঠ পার্ক ও উম্মুক্ত স্থানের চাহিদার বিপরীতে উম্মুক্ত গণপরিসর আছে ০.৯  শতাংশ শতাংশ,  যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। অনুমোদিত ড্যাপ কর্মপরিকল্পনায় ঢাকার মধ্যে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য বিদ্যমান পার্ক ও খেলার মাঠ ও পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ৫৫টি জলকেন্দ্রিক পার্ক ও ১৪টি ইকোপার্ক নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়; যা বাস্তবায়ন করা গেলে উম্মুক্ত গণপরিসরের সংখ্যা বাড়বে। গণমুখী যাতায়াতের জন্য সড়কে দৈনন্দিন জীবনে হাঁটর মাধ্যমে ৬০ শতাংশ যাত্রা সম্পন্ন হয়ে থাকে। ড্যাপে নগরে সুষ্ঠুভাবে হাঁটার জন্য ৩ হাজার ২০৭ কিলোমিটার সড়কে নগর জীবন রেখা বাস্তবায়নে সুপারিশ করা হয়; যা অত্যন্ত জনবান্ধব। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পার্ক ও খেলার মাঠ, জলাধার সংরক্ষণ হাঁটাবান্ধব যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতিসহ বর্জ্য ব্যবস্থানায় ড্যাপ বাস্তবায়ন করা হলে নগরবাসির মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। প্রায় এক বছর হতে চলছে ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ গেজেট প্রকাশ পেয়েছে কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এই যে এখন পর্যন্ত রাজউক কর্তৃক ড্যাপ বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। ধীরগতিতে এর বড় কর্মযোগ্য কীভাবে বাস্তবায়ন হবে বা কবে আলোর মুখ দেখবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। যে কোনো উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় দিকনির্দেশনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ড্যাপ সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করছে তা বাস্তবায়নে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার পূর্ণ সহযোগিতা করা আর না করার ওপর। প্রতিটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নির্ভর করে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের সদিচ্ছার ওপর। কারণ এর আগেও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবে হোঁচট খেয়েছে বারবার। আমরা সবাই আশা করি, ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকা শহরে জনঘনত্ব বিবেচনায় সবার জন্য শহরকে বাসযোগ্য ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সুনিশ্চিতে ড্যাপ বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে। ড্যাপের আলোকে বিদ্যালয়কেন্দ্রিক খেলার মাঠ, পপ-আপ বা ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন শিশুদের জন্য এলাকাভিত্তিক পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে শহরে এলাকাভিত্তিক গণপরিসর তৈরিতে সরকারের আলাদা প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও নিজ নিজ এলাকা/ওয়ার্ডে ছোট ছোট গণপরিসর তৈরিতে মোবাইল প্লেগ্রাউন্ড তৈরির মাধ্যমে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে নদী ও খালগুলো রয়েছে, সেগুলোকে দখল ও দূষণ মুক্ত করে জলাবদ্ধতা নিরসন এবং একটি সমন্বিত পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। আমাদের সড়কে প্রস্থতা নিশ্চিতের পাশাপাশি ফুটপাতগুলোকে পথচারীবান্ধব করতে হবে। ইমারত নির্মাণ আইনের কার্যকারী বাস্তবায়ন করতে হবে। কৃষিজমি রক্ষায় ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন রোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নগর সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ড্যাপ দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি ড্যাপ বাস্তবায়নে রাজনৈতি সদিচ্ছা ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ের মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়া গেলে অন্তর্ভুক্তমূলক বাসযোগ্য শহর তৈরি করা সম্ভব হবে।

উন্নয়ন কর্মী