নীলফামারী হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে অক্সিজেন সংকট

প্রতিনিধি, নীলফামারী : স্থানীয় একটি ক্লিনিকে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে নবজাতককে নেয়া হয় নীলফামারী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার অব নিউনেটাল ইউনিটে।

জেলা সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও ভুক্তভোগী আয়শা সিদ্দিকার (২৪) বাবা আশরাফ আলী অভিযোগ করে বলেন, মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রাত সাড়ে ৯টায় স্থানীয় একটি ক্লিনিকে আমার মেয়েকে সিজারের পর শ্বাসকষ্টজনিত রোগে নবজাতকে (নাতি) ওই রাতেই নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ভর্তি করেন।

এরপর স্পেশাল কেয়ার অব নিউবর্ন (এসকেনিইউ) ওয়াডে নেয়ার পর শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুল আউয়াল রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাসপাতালে এসে তার নিবিড় পরিচর্যায় শিশুটি সুস্থ হয়ে ওঠে। পরদিন বুধবার ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে নার্স ডাক্তারের সঙ্গে কথা না বলেই রংপুরে পাঠিয়ে দেন। এতে ডাক্তারকে ফোন দিতে বললে, এর উত্তরে দায়িত্বরত নার্সরা বলেন, আপনারাই ডাক্তারকে ফোন দেন। এভাবে দুইবার বলার পরও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হস্তান্তর করেন। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

ওই ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স জোশনা বর্মণ বলেন, ‘মঙ্গলবার রাতে শিশুটিকে ভর্তি নেয়ার পর অক্সিজেন সংকটের কারণে শিশুটির অবস্থার অবনতি হলে বুধবার (২৩ আগস্ট) রাত ১০টার দিকে রংপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে, সিনিয়র স্টাফ নার্স কহিনুর আকতার কণা বলেন, এই ইউনিটে চাহিদার তুলনায় অক্সিজেন ও চিকিৎসক না থাকায় বাধ্য হয়ে রংপুরে পাঠানো হয়েছে।

ওই ইউনিটে প্রতিনিয়ত এ ঘটনা ঘটছে। এই হাসপাতালের নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নার্সদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ রোগী ও স্বজনরা। এছাড়া অক্সিজেন, ওষুধ ও বেড সংকটের কারণে এক থেকে ২৮ দিনের নবজাতককেও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

হাসপাতালের স্পেশাল কেয়ার অব নিউবর্ন ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চালু হয়। সেখানে অক্সিজেন থাকার কথা প্রতিটি নবজাতকের জন্য ১০ থেকে ১২ লিটার। কিন্তু সেখানে এর বিপরীতে একজনের জন্য রয়েছে মাত্র ২ লিটার অক্সিজেন। ফলে শ্বাসকষ্টজনিত সিভিয়ার (মরণাপন্ন) নবজাতকদের হরহামেশায় পাঠানো হচ্ছে রংপুরে। সেখানে প্রতিদিন ২০-২৫টি নবজাতক চিকিৎসা নিতে আসে। রেডিও থেরাপি বা অপরিপক্ব শিশুর চিকিৎসার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সেবাকেন্দ্র এটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে সিজারিয়ান নবজাতক ও স্বাভাবিক (নরমাল) প্রসবের শিশুদেরও বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। তবে আয়শার সিদ্দিকার শিশুটি ছিল (সিভিয়ার) গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য প্রত্যেকটি হাসপাতালে শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (নিউনেটাল) একজন চিকিৎসক থাকা একান্ত প্রয়োজন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক নার্স (সেবিকা) বলেন, ‘মেডিকেল অফিসার না থাকায় শিশুদের চিকিৎসা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। একটি শিশুর কখন কী হয় বলা যায় না। সেটি সিনড্রম দেখে বুঝতে হয়। গত মঙ্গলবার এ ইউনিটে একজন নবজাতকে রাতে দ্রুত রংপুরে পাঠাতে হয়। মায়ের অনুপস্থিতিতে সব ধরনের সেবা আমাদের নিশ্চিত করতে হয়। তাই এখানে একজন চিকিৎসক সব সময় থাকা প্রয়োজন।’

হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার আনোয়ার খাতুন বলেন, ‘ওই ইউনিটটি চালাতে ৯-১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দরকার। এর মধ্যে তিন জন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, চারজন নার্স, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী লাগে। এর মধ্যে কর্মরত আছেন শুধু চারজন নার্স। বাকি পদগুলো শূন্য।’

সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের শাহপাড়ার বাসিন্দা ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ফুলবালা (২৪) বলেন, তার এক দিন বয়সের সন্তান জšে§র পর থেকে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (নিউনেটালে) ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে বিছানা না পেয়ে বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আর নার্সদের যে ব্যবহার তা বলাই যায় না।’

একই ইউনিয়নের সুটিপাড়া গ্রামের পাঁচ দিনের নবজাতক নিয়ে আসা সাদিয়া বেগম বলেন, ‘এক বিছানায় দুইটি রোগী নিয়ে থাকা খুবই কষ্ট। এটি শিশুদের জন্য বড় যন্ত্রণার। এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি।’

হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এ সমস্যা বিরাজ করছে। জনবল সংকট, শয্যা সংখ্যা, শৌচাগার, ফিডিং কর্নার, বসার জায়গা ও ইনডোরে ডাক্তার নেই, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বারবার বলার পরেও কাজ হয় না।’

নীলফামারীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবু আল হাজ্জাজ বলেন, ‘নবজাতকদের অক্সিজেন ও চিকিৎসক সংকটের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি, পাশেই সাততলা নতুন ভবনটি চালু হলে চিকিৎসকসহ এসব সমস্যা থাকবে না।’