রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের দাবি জোরদার হচ্ছে

মাহমুদুল হক আনসারী:রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল বাড়ছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্ট সন্ত্রাস, অপহরণ এবং নারী ও শিশু পাচার অহরহ ঘটছে। বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে তারা অবস্থান করছে। এদেশের সরকার ও জনগণ মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিলেও বর্তমানে এ অঞ্চলের জন্য তারা আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে তারা নানাভাবে ঢুকে পড়ছে। বাংলাদেশের এনআইডি ও জš§নিবন্ধন বিভিন্ন কৌশল করে স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারা সংগ্রহ করছে। মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে অবৈধ পথে পাসপোর্ট পর্যন্ত সংগ্রহ করছে। এগুলো ব্যবহার করে স্থল ও নৌপথে বাংলাদেশের বাইরে পাড়ি জমানোর জন্য চেষ্টা করছে। সমুদ্রপথে নারী ও শিশু পাচার করছে। একটি সিন্ডিকেট শক্তভাবে তাদের এসব পথে ব্যবহার করছে। এ অঞ্চলের সব রকমের মাদকের পাচারের সঙ্গে রোহিঙ্গারা নানাভাবে সম্পৃক্ত।

তাদের কারণে মাদক, নারী ও শিশু পাচার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দিন দিন তারা হিংস্র হয়ে উঠছে। তাদের কারণে বাংলাদেশি স্থানীয় নাগরিকরা নানাভাবে দৈনন্দিন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও মাদক পাচারকারী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার এবং পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৈৗমত্ববিরোধী চক্রান্তে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী জড়িত রয়েছে বলে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। তারা দেশের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও সার্বভৈৗমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এসব সন্ত্রাসীকে কতিপয় গোষ্ঠী মদত দিচ্ছে বলেও অভিযোগ শোনা যায়। এনজিও নামক অগণিত প্রতিষ্ঠান তাদের নিয়ে কাজ করছে। দেশ-বিদেশ থেকে তারা তাদের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে আসছে। অনুদানের অর্থ তাদের দেখিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে। প্রতিষ্ঠানের মালিকরা অনেকেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ। এগুলো সবকিছু বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে সচেতন জনগণ।

তাদের মধ্যে নিরীহ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন চাইলেও কতিপয় রোহিঙ্গা লিডার ফেরত যেতে চান না। প্রত্যাবর্তনবিরোধী ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত আছে। তাদের মদত দিচ্ছে দেশি-বিদেশি মহল। তাদের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের জনগণ দ্রুততার মধ্যে চায়। তাদের মায়ানমার সরকার পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে তাদের নিজ নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তন করুক, সেটিই এদেশের জনগণ চায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে যারা অবস্থান করছে, অন্য দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, যারা তাদের কাছে গিয়ে সহানুভূতি জানায় তাদের বলব, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করুন। সেই জায়গায় সার্বিক সহযোগিতা করুন। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের নিয়ে নানাভাবে দিপক্ষীয় আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। তাদের বিষয়ে বাংলাদেশের পাশে থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেভাবে আগ্রহ ও তৎপরতা, সেই ধরনের তৎপরতা এদেশের জনগণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে দেখতে চায়।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নানা কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। অত্যন্ত মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দেয় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অঞ্চলে। সে দেশের জনতা ও সরকার তাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালালে তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক নির্মমভাবে তাদের হাতে নিহত হয়। গুম করে অপহরণ করা হয়। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায়। এ দৃশ্য সারা পৃথিবী অবলোকন করেছে। ২০১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিছিলে মিছিলে বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়। তাদের জন্য উদ্বাস্তু ক্যাম্প তৈরি করা হয়। নারী, শিশু, বৃদ্ধবনিতা ও শিক্ষিত-অশিক্ষিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের টেকনাফ কক্সবাজারে ক্যাম্প তৈরি করে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়। তাদের আশ্রয় দেয়ার পর সারা পৃথিবী বাংলাদেশ সরকারকে মানবিকতার এই আচরণের জন্য ধন্যবাদ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের পাশে আন্তর্জাতিক দেশ সংগঠন সংস্থা দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহল সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রায় ১২ লাখের অধিক এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করছে। তাদের কারণে সে অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়-পর্বত বিলীন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা তাদের ক্যাম্পে বসে বসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় খেয়েদেয়ে বেঁচে আছে। তারা ঠিকমতো আহার পাচ্ছে এবং চিকিৎসা হচ্ছে। তাদের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে নিরলসভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের সেবা দিচ্ছে। এরপরেও রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময় নানা ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচার-আচরণ করছে। তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। তারা চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। নারী শিশু পাচার করছে।

একটি চক্র রোহিঙ্গাদের থেকে নারী ও শিশুদের প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার করছে। ওত পেতে থাকা কতিপয় রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে। কোনোভাবেই তাদের তাদের ক্যাম্পে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তারা কোনো নির্দেশনা মানছে না। তাদের জন্য কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। দেশি-বিদেশি নানা সাহায্য সংস্থা তাদের নিয়মিত সহায়তা দিচ্ছে। এরপরও তাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, আইন ও আনুগত্য না মানা ছাড়াও বিভিন্নভাবে তারা এদেশের শৃঙ্খলা মানছে না। সেটি এখন আমরা দেখছি। বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে জাতীয় আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনেক চেষ্টা ও আলোচনা-বৈঠক চালিয়ে আসছে। কিন্তু মিয়ানমারের সরকার আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে রাজি হলেও বাস্তবে এ পর্যন্ত তারা একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। পার্শ্ববর্তী দেশের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বারবার চেষ্টা করছে। রোহিঙ্গাদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির সাপেক্ষে তাদের সে দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু সেটি মোটেও সফল হচ্ছে না।

এরই মধ্যে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলতে দেখা যাচ্ছে। অনেক সন্ত্রাসী গ্রুপ ক্যাম্পগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা নানা ধরনের জঙ্গি সংগঠনের ওই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়ার সংবাদ পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল সারকিয়ার সৌর সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধানকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর বাইরেও রোহিঙ্গাদের গড়া বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন সেখানে জš§ নিয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল ছড়িয়ে পড়ছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তাদের মধ্যে অন্তঃকোন্দল ছড়িয়ে পড়ছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়মিতভাবে চলছে। একে অপরকে হত্যা করতে তারা বেপরোয়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ বলে জনগণ মনে করে। এই সন্ত্রাসের সঙ্গে একশ্রেণির এনজিও সেবা সংস্থা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার অভিযোগ শোনা যায়।

রোহিঙ্গাদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ঠিকমতো তাদের পেছনে খরচ করছে না, এমন এনজিও সেখানে কাজ করছে, সেটাও আমরা জানতে পারি। তাদের জন্য আনা অর্থ নানাভাবে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করছেন। নানাভাবে তারা সেটা অন্যখানে ব্যয় করছে, অন্য কাজে ব্যয় করছে। ইচ্ছামতো তারা তা ব্যয় করছে। যে উদ্দেশ্যে যেসব দেশ তাদের জন্য অর্থ পাঠায়, সে অর্থ সেখানে যথাযথভাবে ব্যয় করছে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশাল একটি বাণিজ্য বাংলাদেশের চলছে। বৈধ-অবৈধভাবে অনেক ধরনের সংস্থা এখানে রোহিঙ্গাদের সাইনবোর্ড বানিয়ে কাজ করছে। বাস্তবে রোহিঙ্গারা বেঁচে থাকলেও তাদের বক্তব্য হলো আত্মমর্যাদাহীন অবস্থায় তারা সেখানে আছে। অনেক রোহিঙ্গার বক্তব্য থেকে জানা যায়, তারা পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে তাদের নিজ বসতভিটায় চলে যেতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মহলের রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য যেটি করা দরকার, যা করা দরকার, তা এখনও হচ্ছে না। ফলে তারা আজকে বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল। কারও  নিয়ম-নীতি তারা মানছে না। অন্তঃকোন্দলে তারা বিভক্ত।

তারা নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এতে এ অঞ্চলসহ বাংলাদেশের মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এদেশের জনগণের প্রত্যাশা অবিলম্বে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এবং আরও যাদের রাখতে হয় জাতীয় আন্তর্জাতিক ফোরাম তৈরি করে, তাদের নিজ দেশে পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান করার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করা হোক। অন্যথায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এবং এদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্য তাদের অবস্থান আমাদের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এ হুমকি থেকে বাঁচতে হলে জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করতে হবে। সেটি যতদিন না হবে, ততদিন রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা, তাদের নির্দিষ্ট সীমানায় রাখা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। আশা করছি যতদিন না তাদের প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি বাস্তবায়িত না হয়, সে পর্যন্ত তাদের কঠোর নিয়মশৃঙ্খলায় রাখার সব ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করবে।

মুক্ত লেখক, চট্টগ্রাম

ma-masumÑyahoo.com