সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধু গড়ার প্রবণতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বন্ধুত্ব যেন আটকা পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বেড়াজালে। ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ওপাশ থেকে গ্রহণ করলেই হয় বার্তার আদান-প্রদান। জীবনে কোনোদিন দেখা হয়নি এমন লোকও বনে যায় বন্ধু। দুঃখের বিষয় হলো, বন্ধু তালিকায় থাকলেই যে বন্ধু হওয়া যায় নাÑ এমনটি বুঝতে পারছি না আমরা। ডিজিটাল মাধ্যমে মেকি ও মিথ্যা বন্ধুত্বে জড়িয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন বহু মানুষ। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এমন প্রবণতা অধিক মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। ফেসবুকে পরিচয়ের মাধ্যমে হওয়া বন্ধুত্বের নেই গ্রহণযোগ্য কোনো অবস্থান। এমনকি এই বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব নিয়েও নেই নিশ্চয়তা। ডিজিটাল মাধ্যমে বন্ধু হওয়ার পর অনেকেই হারিয়েছেন প্রাণÑএমন সংবাদও আমাদের অজানা নয়। ফেসবুকে পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব তারপর প্রেমে জড়িয়ে স্বামীর সংসার ছেড়েছেন কতজন নারী; তাও নিশ্চিত করে বলা বড় দায়। কত পুরুষ স্ত্রীর অগোচরে জড়িয়েছেন ডিজিটাল পরকীয়ায়Ñ সেটিও অজানা আমাদের। কেন বাড়ছে অনলাইননির্ভর বন্ধুত্ব? অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সহজলভ্যতা ও অবাধে ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বাড়ছে এ ধরনের বন্ধুত্ব। যার ফলে কাজ-কর্ম রেখে অধিক সময় ধরে অনলাইন মাধ্যমে আসক্তও হচ্ছেন অনেকে। বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখে মনে হচ্ছে, নিজেদের বিবেকবুদ্ধি খুইয়ে আবেগের স্বর্গে জড়িয়ে পড়ছে সমাজ, দেশ ও জাতি।
আবেগতাড়িত এই নরক থেকে তবে উত্তরণের কোনো উপায় কি নেই? এমন প্রশ্নের উত্তর দেয়ারও এসেছে সময়। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীন নিজেদের স্কুল, কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য টিকটকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেঁধে দিয়েছে সময়। এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যবহার করা যাবে না টিকটক এমন নীতিও প্রচলিত রয়েছে দেশটিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের বদলে সীমিত পরিসরে তারা ব্যবহার করছে উইচ্যাট নামীয় একটি নিজস্ব যোগাযোগ মাধ্যম। অর্থাৎ বলতে গেলে তাদের আসক্তির জায়গাটি এখানে দুর্বল হওয়ায় মেকি ও মিথ্যা বন্ধুত্বের জয়গান কমই ধ্বনিত হয় তাদের অঙ্গনে। অথচ সামাজিক মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে আমাদের শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশে এমন প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
এবার আসি ডিজিটাল বন্ধুর চেয়ে প্রকৃত বন্ধু কেন বেশি প্রয়োজন সে আলোচনায়। একজন প্রকৃত বন্ধু মাত্রই সুখে-দুঃখের সঙ্গে। সুসময়ে যেমন পাশে থাকে একজন প্রকৃত বন্ধু ঠিক তেমনই থাকে দুঃসময়ে। প্রকৃত বন্ধুত্ব দেখে না খ্যাতি, জনপ্রিয়তা কিংবা ফেসবুকের মতো ফলোওয়ার। অন্তরের সৌন্দর্য এখানে পায় অধিক মূল্য। কেবল বাস্তব জীবনেই সম্ভব বন্ধুত্বের পূর্ণতা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃত বন্ধুত্ব কখনও ডিজিটাল মাধ্যমে তৈরি হয় না। বাস্তব জীবনেই কেবলমাত্র তৈরি হয় প্রকৃত বন্ধুত্ব। ডিজিটাল মাধ্যমের বন্ধুত্ব লাইক, কমেন্টস কিংবা শেয়ারে আটকা থাকলেও প্রকৃত বন্ধুত্ব কখনও দেখে না এমন কোনো বিষয়।
মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের সকল বিষয়। যার দরুন এটির প্রভাব পড়েছে বন্ধুত্বেও। দেখা যাচ্ছে একজন ব্যক্তির জনপ্রিয়তা, অর্থ, প্রভাব কিংবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়া থেকেই গড়ে উঠছে আমাদের ডিজিটাল মাধ্যমের বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব যে আমাদের জন্য উপকারী নয় এমন ভাবনা আমাদেরকেই ভাবতে হবে। সর্বোপরি ডিজিটাল মাধ্যমে বন্ধু তৈরি থেকে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রকৃত বন্ধু কেবল বাস্তব জীবনেই হবে ডিজিটাল মাধ্যমে নয়। কেননা জীবনের দুর্বিষহ মুহূর্তে প্রকৃত বন্ধুই থাকে বন্ধুর পাশে। প্রকৃত বন্ধুত্বে নেই বিশ্বাসঘাতকতা নেই মেকি সম্পর্কের আভাস। এখানে রয়েছে কেবল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মায়া, মমতা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। তাই বলতেই হয় বন্ধুত্বের মানদণ্ডে শতকোটি পাউন্ড এগিয়ে প্রকৃত বন্ধুত্ব।
জিহাদ হোসেন রাহাত
শিক্ষার্থী, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ