আমাদের সমাজে প্রচলিত একটা কথা আছে, নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হয়। এই পণ্য হিসেবে দেখার বিষয়টি কেউ স্বীকার করেন, আবার কেউ নারীর জন্য বরাদ্দ করা বাস্তবিক পণ্য ধারণার যে বিশেষণ দেয়া হয়, তা অস্বীকার করেন। এই পক্ষ বা বিপক্ষ শ্রেণির মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ধারণা থেকে বলা যেতে পারে, পণ্য মনে করার শ্রেণিই বেশি এগিয়ে সংখ্যার বিচারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীকে নিরপেক্ষ মূল্যালয়ন করা মানুষের সংখ্যা থেকে অবমূল্যায়ন করা, অবহেলা করা, ভোগের পণ্য মনে করার সংখ্যাই বেশি।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে বলা হয় নারী জাগরণের অগ্রদূত। তিনিই প্রথম নারীর মুক্তি নিয়ে সংগ্রাম করে গেছেন। তখন সমাজ ব্যবস্থা এমন ছিল, নারীর পড়াশোনা করার কোনো সুযোগ ছিল না। কেউ কেউ যে- প্রয়োজন অনুভব করেনি; এমন ঢালাও কথাও বলা যায় না। তবে এটা ঠিক, ওই রকম পরিবেশ তখনও তৈরি হয়নি যে, নারীর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে কেউ সমাজে প্রকাশ করবে। তখন বাবা-মেয়েকে দেখতো পণ্য হিসেবে, মা মেয়েকে দেখতো মেয়ের ভবিষ্যৎ স্বামীর দেহ হিসেবে। ভাই তার বোনকে মূর্খ দেখতে পছন্দ করত।
বেগম রোকেয়ার দুই ভাই, মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়াম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। ছোট বোন রোকেয়াকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী সবার অন্তরালে পড়াশোনা করাতেন।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষা গ্রহণ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দুই ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। বড় ভাই-বোনদের সমর্থনে- বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাই ভালোভাবে আয়ত্ত করেন। বেগম রোকেয়ার আমল থেকে নারী বর্তমানে যে সুন্দর জীবনযাপন করছে; এতে কারও সন্দেহ নেই। তবে, জীবনের বোঝা এখনও মাথার ওপর থেকে নামেনি তা অস্বীকার করবে কে? মানসিকতার জায়গা থেকে এখনও তেমন বেশি পরিবর্তন এসেছে, এটি বলা যাবে না।
আমাদের সমাজে নারী মাত্রই শোষিত। এই শোষণ কেউ অনুধাবন করতে পারে, কেউবা সে শোষণ বিজয়ী যোদ্ধার কর্তৃত্ব বলে মনে করে।
চীনের বিপ্লবের পর মাও সেতুং বলেছিলেন, ‘বিপ্লবের আগে চীনের পুরুষদের বইতে লেখা হতো সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তিনটি পর্বত। আর চীনের নারীদের বইতে লেখা হতো চারটি পর্বতÑসামন্তবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং চতুর্থটি পুরুষ।‘ সেকো তোরে নিউল্যান্ডে বলেছিলেন, গিনির নারীরা ‘ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী’।
নারী অনেক এগিয়েছে। কিন্তু আমাদের মানসিকতা কতটুকু এগোচ্ছে? ঢাকাতে যখন পুরুষের থেকে নারীরা বেশি ডিভোর্স দিচ্ছে বলে রিপোর্ট বাহির হলো, তখন তেমন কাউকে দেখিনি যে পুরুষের দোষের কথা কেউ বলেছে। এমন অনেকেই আছেন যারা এটাকে নারী উন্নয়নের কুফল হিসেবে দেখেন। কিন্তু তারা কখনও ভাবেন না, পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে একজন শিক্ষিত নারী কখনোই বন্দি হতে চাইবে না। এটাই স্বাভাবিক। পুরুষের কালো হাতে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়াÑ নারী কেন মেনে নেবে? নারী থাকবে মুক্ত, স্বাধীন।
হুমায়ূন আজাদের একটা কথা দিয়েই শেষ করি, পৃথিবীতে শুধু নারীই শোষিত নয়, অধিকাংশ পুরুষও এখনও শৃঙ্খলিত ও শোষিত। তবে শোষিত শৃঙ্খলিত নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য: সব শ্রেণির পুরুষ বন্দি ও শোষিত নয়, কিন্তু সব শ্রেণির নারীই বন্দি ও শোষিত।”
তাজুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়