বাংলাদেশ ব্র্যান্ড বাস্তবায়নে চামড়াজাত শিল্পের বাধা দূর করতে হবে

মিজানুর রহমান : চামড়াজাত শিল্পের স্বকীয়তা বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প দেশে তৃতীয় রপ্তানিকৃত পণ্য হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু এ চামড়াশিল্পের যথেষ্ট বেহাল অবস্থা বিদ্যমান। ঈদ এলে এটা টের পাওয়া যায়। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল আজহায় প্রচুর পরিমাণে গরু, ছাগল, মহিষ জবাই হয়। চামড়া ও সংগ্রহ হয়। বিক্রেতারা কিন্তু চামড়ার ন্যায্য মূল্য পান না। মাঠ পর্যায়ে যারা চামড়া ক্রয় করেন তাদের বক্তব্য অনুযায়ী ট্যানারি মালিকদের কাছে ২-৩ বছরের চামড়ার টাকা বকেয়া থাকে। পরিশোধের ক্ষেত্রে মালিকরা ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ টাকা পরিশোধ করে। বাকিটা করতে টালবাহানা করে। তাহলে চামড়ার প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা লাভের মুখ দেখবে কী করে?

কোরবানির ঈদ ছাড়া ও সারা বছরই মাংসের চাহিদার কারণে পশুর চামড়া পাওয়া যায়। পশুর চামড়া ব্যবসা হিসেবে শুরু হয়েছে চল্লিশের দশকে। ১৯৪০ সালে রণদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) নারায়ণগঞ্জের কাছে সর্বপ্রথম একটি ট্যানারি স্থাপন করেন। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন সরকার ঘোষিত এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্প স্থাপন করা হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে।

বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে চামড়াশিল্পের আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের দুটি মাত্র কোম্পানির  এলডব্লিউজির সনদ রয়েছে। এরা হলো চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত টিকে গ্রুপ এবং এপেক্স ফুটওয়ার কোম্পানি। বাংলাদেশ মূলত ব্র্যান্ডিং কোম্পানি ব্যতীত অন্যদের কাছে পণ্য বিক্রি করায় সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে এলডব্লিউজির সনদ না থাকায় বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলার আয় হারাচ্ছে।

পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের লিড সনদ পোশাক কারখানাকে  ক্রয়াদেশ ও ভালো দাম পেতে সহায়তা করে। তেমনি মানের ক্ষেত্রে  চামড়া খাতে এলডব্লিউজির সনদ কাজে লাগে। বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে গেলে এলডব্লিউজির  সনদ সংগ্রহ করা জরুরি। বিখ্যাত ব্র্যান্ডিং কোম্পানি নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বার এদের মতো কয়েকটি কোম্পানি একত্র হয়ে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারীরা ২০০৫ সালে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষা করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করার বিষয়টি নিশ্চত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান  এলডব্লিউজির সদস্য।  এলডব্লিউজি  চামড়া অডিট করতে গিয়ে গোল্ড, সিলভার, ব্রোঞ্চ ও সাধারণ মান অনুযায়ী শ্রেণিভুক্ত করা হয়। এলডব্লিউজি  যে বিষয়গুলো নিরীক্ষণের সময় প্রাধান্য দেয় যেমনÑপরিবেশ ব্যবস্থাপনা ক্ষতিকর রাসায়নিক বা অন্যান্য উপাদানের ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস, জ্বালানি ও পানির ব্যবহার ইত্যাদি নানা বিষয়ে খতিয়ে দেখে এরা। পরিবেশ দূষণ থেকে বাঁচার জন্যই হাজারীবাগ থেকে  ট্যানারি সাভারে নেয়া হয়।

বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকার দূষণ কমাতে ২০০৩ সালের সাভারে চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকায় সাভারের হেমায়েতপুরে ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি যখন সরিয়ে নেয়া হয় সাভারে, সেখানে ২০১২ সালে একটি চীনা কোম্পানি ৫৪৭ কোটি টাকায় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার প্রকল্প (সিইটিপি) নির্মাণের কাজ পায়। কিন্তু সিইটিপির নির্মাণকাজ ক্রটি থাকায় শুরু থেকে এটি কার্যকর ছিল না।

বিসিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী সিইটিপির দৈনিক বর্জ্য পরিশোধের ক্ষমতা ২৫ হাজার ঘনমিটার অথচ মৌসুমে বর্জ্য হয় ৪০ হাজার ঘনমিটার। কিন্তু ক্ষমতার চেয়ে প্রাপ্তি হলো দৈনিক বর্জ্য পরিশোধ হয় ১৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার ঘনমিটার। কিন্তু বর্তমানে সিইটিপি সক্ষমতার ৫৫ ভাগ ব্যবহƒত হচ্ছে। বিসিকের ভাষ্য অনুযায়ী,  প্রতিদিনই তরল বর্জ্যরে বড় একটি অংশ পরিশোধন ছাড়াই চামড়া শিল্প নগরীর পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরীতে গিয়ে পড়ছে। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। সিইটিপি পরিবেশ দূষণের কারণে নিয়মিত জরিমানা গুনতে হচ্ছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত কোম্পানিকে ২ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। বিসিকের তথ্য মতে, বর্তমান অকার্যকর সিইটিপি কার্যকর করতে শতাধিক যন্ত্র ও  যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন করতে হবে। এ কাজে অন্তত ১৪১ কোটি থেকে ১৬১ কোটি টাকা দরকার। সিইটিপি সংস্কারের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান অথবা উভয়পক্ষের যৌথ উদ্যোক্তার মাধ্যমে অর্থ বিনিয়োগ নিয়ে সমীক্ষা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। সরকারও বলছে, সিইটিপি সংস্কার এখন অগ্রাধিকার বিষয়। কারণ রপ্তানি আয় কেন আমরা হারাব? এ খাতে প্রচুর আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। সিইটিপিকে দেশের স্বার্থে সংস্করণ করা দরকার। এ অবস্থার মধ্যেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে যাচ্ছে। ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২২ কোটি ডলার। সে হিসাবে গত পাঁচ বছরে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৯.৬০ শতাংশ। ইপিবির তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে চামড়াজাত পণ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬২.৫০ শতাংশ। চামড়া, পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য থেকে গত পাঁচ বছরে মোট আয়ের মধ্যে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এসেছে ১০২ কোটি ডলার। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮০ কোটি ডলার, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৯০ কোটি ডলার, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১২৪ কোটি ডলার, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১২২ কোটি ডলার এসেছে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা দ্বিগুণ হতে পারত যদি বৈশ্বিক মন্দা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রভাব না পড়ত। যদি সেই সঙ্গে সাভারের হেমায়েতপুরের ট্যানারিপল্লির সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর থাকত। তারপরও চামড়াজাত পণ্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের ক্রেতা বাড়ছে। চীনবিমুখ ক্রেতারাও বাংলাদেশের প্রতি ঝুঁকছেন।

বেসরকারি সংস্থা গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্য মতে, ২০২২ সালে চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল ২৫ হাজার ৩৮২ কোটি ডলারের। প্রতিবছরই চামড়া ও পণ্যের বাজার বাড়ছে। সেখানে আমাদের দেশের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। যেহেতু আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে চামড়া সংগ্রহ করা যায় এ শিল্প খাতের ওপর সরকারের নজর দেয়া দরকার। সাভারের পরিশোধনাগারটি সরকারের সহযোগিতা ছাড়া উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। সনদ প্রাপ্তির স্বার্থে এটি সংস্করণ করতে হবে। সম্প্রতি চামড়ার একটি সেমিনারে বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চামড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড সৃষ্টি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অতিদ্রুত সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশন তথা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ ও সাসটেইনেবল লেদার ফাউন্ডেশন প্রভৃতি অর্জন উপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সবকিছু সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন” চামড়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আশা করা যাচ্ছে, চামড়াশিল্পের বাংলাদেশ ব্র্যান্ড বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং এ খাতের গতি সঞ্চার হবে।

ব্যাংকার, মুক্ত লেখক