শিক্ষার্থীবান্ধব পাঠ্যক্রমই কাম্য

রেহেনুমা সেহেলী কবির: একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। তবে সে শিক্ষাব্যবস্থা অবশ্যই হতে হবে শিক্ষার্থীর জন্য অনুক‚ল! কিন্তু বর্তমানে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান। সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি উঠে এসেছে। নতুন এই কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষাদানের যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তার বেশিরভাগই উপকরণনির্ভর শিখন পদ্ধতি। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শ্রেণির কাজ সম্পাদনের জন্য রঙিন কাগজ, রঙিন কলম, সব ধরনের কাগজসহ বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের প্রয়োজন বৃদ্ধি পাওয়ায় পড়াশোনার ব্যয়ও অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাসামগ্রীর দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে খুব দ্রæত গতিতে। সেক্ষেত্রে এসব বাড়তি শিক্ষাসামগ্রীর আবশ্যকতা পড়াশোনা খাতকে অধিকতর ব্যয়বহুল করে তুলেছে, যা বহন করতে দরিদ্র এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। আর এতে করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে একপ্রকার বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এছাড়া নতুন কারিকুলামে রান্নাবান্নাসহ বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এসব হাতে-কলমে শেখানোর কাজে শিক্ষা উপকরণের ধরনেও এসেছে নতুন সংযোজন। সময় ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখা ব্যবহারিক বিষয়গুলোকেও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মহলে এ নিয়ে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ এই নতুন সংযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করলেও এর উল্টো চিত্র সত্যিই হতাশাজনক। এছাড়া অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অধিকতর প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে সরবরাহকৃত উত্তর দেখে দেখে অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীরা কতটা উপকৃত হচ্ছে তা সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন কাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষার্থীদের গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হচ্ছে, যার ফলে তাদের বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অন্যদিকে প্রাজেক্টগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের দুষ্প্রাপ্যতা ও উচ্চ বাজারমূল্যের কারণে এসব কিনে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসরণে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রজীবন ও পরীক্ষা এই দুইয়ের মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের ইতি টেনেছে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম। পরীক্ষাবিহীন মূল্যায়ননির্ভর শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের মুখস্থনির্ভরতা খানিকটা কমাতে সক্ষম হলেও এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব অনেকাংশে প্রভাবিত হবে।
ফলে জীবনের পরবর্তী ধাপের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার্জন নিছক জ্ঞান সাধনা নয়, বরং এই শিক্ষা আমাদের সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহের পূর্বশর্তও বটে। এছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ নি¤œমধ্যবিত্তের সমাজে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যয় বৃদ্ধি পেলে তা জনসাধারণের জন্য বিলাসিতায় রূপ নেবে। এছাড়া পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল, তথ্যবিকৃতি, চৌর্যবৃত্তি, ভুল তথ্যের উপস্থাপন প্রভৃতি পরিহার করতে হবে। কারণ এই ভুলগুলো শুধু অদক্ষতাই নয়, কিংবা অসাবধানতাই নয়, এটি অমার্জনীয় অপরাধ, শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কারণ এবং যেকোনো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অন্তরায়। তাই শুধু যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন নয়, বরং প্রণীত কারিকুলামের বিশুদ্ধতা নিরূপণ, শিক্ষক ও অভিভাবক মহলের গ্রহণযোগ্যতা এবং ব্যয়ভার বহনের সক্ষমতার কথা বিবেচনা করে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা উচিত। অন্যথায় পড়াশোনা শ্রেণিবৈষম্য বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মনে হতাশার জš§ দেবে, যা কখনোই কাম্য নয়।

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ