নিজস্ব প্রতিবেদক: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দশ মাসে দেশে ২ হাজার ৫৭৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসবের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯৭ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ১১৫ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ জনকে, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৮৯ জনের সঙ্গে। এছাড়া বৃহৎ সংখ্যার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৪৩৩ জনকে, রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ২৩১ জনের, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১১ জন, আত্মহত্যা করেছেন ২০৭ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ১২২ জন, যৌননিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১৪২ জন। গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন পরিষদের লিগ্যালএইড সম্পাদক রেখা সাহা। পরিষদটি ১২টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে রেখা সাহা বলেন, ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। এদিন থেকেই শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। সারাবিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন নারী সমাজের পক্ষ থেকে ৪২ বছর আগে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ এ দিবসটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
পরবর্তীকালে জাতিসংঘ নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও বন্ধের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রচার-প্রচারণা বেগবান করার উদ্দেশ্যে ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত ১৬ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করে, একই সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এ সময়কালে কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানায়। সে হিসেবে আমরাও কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যক্তি/পরিবার ও নাগরিক সমাজের করণীয়
পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং সহনশীলতার সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে, পরিবারে শিশু-কিশোরদের নারীদের সম্মান দেয়ার শিক্ষা দিতে হবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে, পরিবারের সব ক্ষেত্রে পুত্র ও কন্যার সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে, পরিবারের অভ্যন্তরে যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে তাদের সহযোগিতা করতে হবে, ধর্ষণের ঘটনায় যেকোনো ধরনের সালিশি মীমাংসা এবং ধর্ষণকারীর সঙ্গে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে এবং নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
রাষ্ট্র/সরকারের করণীয়
নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করতে হবে, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ এবং নির্মূলে সমন্বিত বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, বিরাজমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেন্ডার, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার কারণ ও প্রভাব সম্পর্কে সহায়ক কার্যক্রম চালু করতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নরোধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে আইন প্রণয়ন করতে হবে, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে জাতীয় নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০-এর প্রচার ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে, পাঠ্যসূচিতে নারীর মানবাধিকার, নারী-পুরুষের সমতার ধারণা যুক্ত করতে হবে, বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পদ-সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করতে হবে। আরও রয়েছে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না মনিটরিং করতে হবে, অপরাধীকে কোনোরকম রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে, সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সমাবেশের নামে নারীর প্রতি নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা (অনলাইন, অফলাইন) কঠোরভাবে দমন করতে হবে। একই সঙ্গে নারীর জন্য ক্ষতিকর প্রথা (বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত সালিশি কার্যক্রম, বহুবিবাহ) বন্ধ করতে হবে, জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬ (১)(গ)-এর ওপর থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে, নারীর মজুরিবিহীন গৃহশ্রমকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারাবাহিকভাবে জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাদের কাউন্সেলিং সেবা দেয়ার ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে হবে, সমকাজে সমমজুরির নিশ্চয়তা দিতে হবে, নারীদের জন্য অধিক সংখ্যায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করতে হবে, নারীবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশকে উৎসাহিত করতে সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া তরুণ প্রজš§কে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে জেন্ডার সংবেদনশীল করার লক্ষ্যে পাঠ্যসূচিতে সাইবার বুলিং, সাইবার ক্রাইম যুক্ত করতে হবে এবং নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময়ে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনসহ নারী ও কন্যার ওপর সব প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধে বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গণমাধ্যমের করণীয়
গণমাধ্যমে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে; জেন্ডারভিত্তিক শ্রম বিভাজনের সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারণার উদ্যোগ নিতে হবে; নারী ও কন্যার প্রতি অনলাইনে সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে।
নারী আন্দোলনের করণীয়
নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আন্দোলন শক্তিশালী করতে হবে; নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তরুণ প্রজš§সহ সব শ্রেণিপেশার পুরুষকে যুক্ত করে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং নারীদের মধ্যে আত্মশক্তি, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার জন্য উদ্দীপনামূলক নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেনÑবাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুসহ অন্যরা।