মো. নাজমুল ইসলাম: গতানুগতিক শিক্ষা ধারা থেকে বের হয়ে অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা ও বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে একটি যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণিতে তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় আনা হবে। আর ২০২৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কার্যক্রম।
তবে এটিকে কেন্দ্র করে অভিভাবকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
এ কারিকুলামটি ১৯৮৪ সালে আমেরিকান শিক্ষাবিদ উধারফ অষষবহ কড়ষন প্রবর্তন করেন। এর চারটি ধাপ রয়েছে: ১. প্রেক্ষাপট নির্ভর শিখন, ২. প্রতিফলনমূলক শিক্ষা, ৩. বিমূর্ত ধারণায়ন, ৪. সক্রিয় পরীক্ষণ। মূলত এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু মুখস্থবিদ্যা আর লিখিত পরীক্ষার পরিবর্তে সৃজনশীলতা, এবং দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা হবে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম নিঃসন্দেহে সম্ভাবনাময়। যেহেতু এটি একটি থিওরি, ফলে এর ভালো এবং খারাপ দিক উভয়ই থাকবে এটিই স্বাভাবিক। তবে মূল উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এ শিক্ষাক্রমকে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষাবিদরা।
যে কোনো থিওরি অথবা মতবাদ তৈরি করা হয় নির্দিষ্ট লক্ষ সামনে রেখে। একটি সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে যে মতবাদ গড়ে উঠে সেটিকে অন্য সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা সমাজে প্রয়োগ করলে অনেক সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। মূলত পশ্চিমাদের অধিকাংশ মতবাদই ধর্মহীন, শুধু দুনিয়াবী কল্যাণকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়। গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সেক্যুলারিজম তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে এদেশের মানুষ দুনিয়া এবং পরকাল উভয়কেই সমানভাবে মূল্যায়ন করে। ফলে এসব মতবাদ ধর্মপ্রাণ সমাজে সরাসরি প্রয়োগ করলে মানুষের মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
ঞযব ঈষধংয ড়ভ ঈরারষরু ধপঃরড়হং ধহফ ঃযব জবসধশরহম ড়ভ ডড়ৎষফ ঙৎফবৎ-এর লেখক হান্টিংটন বলেন: (কিছু দেশ) তারা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অস্বীকার করে নিজেদের দেশের পরিচয় একটি সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার দিকে নিয়ে যেতে চায়। আজ পর্যন্ত এ-ধরনের কার্যকলাপ দ্বারা কেউ সফল হতে পারেনি; বরং তারা তাদের দেশকে একটি ’ছিন্নরাষ্ট্রে’ পরিণত করেছে।
এজন্য পশ্চিমা বিশ্ব থেকে কোন মতবাদ অথবা থিওরি আমাদের সংস্কৃতিতে বাস্তবায়ন করতে চাইলে দুটি বিষয় করণীয়: ১. সমগ্র জাতিকে ওই মতবাদ গ্রহণের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা (অর্থাৎ আখেরাত বিমুখ জড়বাদী হওয়া) ২. এ মতবাদটিকে মডিফাই করে আমাদের সংস্কৃতির উপযোগী করে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। যেমনটি ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায়ন ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু করেছেন।
তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রথম বিষয়টিই লক্ষ্য করছি। বাঙালিদের আসল সংস্কৃতি ধর্মকে কেন্দ্র করে অথচ এই সংস্কৃতিকেই তারা পরিবর্তন করতে চায়। তারা ধর্মকে সংকুচিত করে পশ্চিমাদের অনুসরণে একটি সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। লেখক ও গবেষক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকুচিত করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ কমিটির প্রতিবেদনকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়েছেন। অথচ কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব ছিল ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও ইসলামের প্রতি অবজ্ঞা ও উপহাসের বহিঃপ্রকাশ। আসলে কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ইসলামী আদর্শ বিরোধী এক কালো দলিল। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শিক নৈতিকতা থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে রেখে একটি ধর্মবিবর্জিত ‘ইহ-জাগতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল’ তৈরির উপযোগী জনবল সৃষ্টিই বর্তমান শিক্ষা কমিটির অন্যতম উদ্দেশ্য।
ইতঃপূর্বে ধর্মশিক্ষা স্কুলের সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বিভিন্নভাবে এ বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বহীন ছিল। যার ফলে এটির প্রভাব শিক্ষার্থীদের মাঝে খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। এখন আবার এটিকে ধর্ম শিক্ষা থেকে শুধু নৈতিক শিক্ষায় নামিয়ে আনার পাঁয়তারা চলছে। ধর্ম এবং নৈতিক শিক্ষা দুটির মধ্যে ঢের তফাৎ রয়েছে। নৈতিক শিক্ষা অর্জন করতে আখেরাতে বিশ্বাসী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ধর্মশিক্ষার জন্য পরকালে বিশ্বাস আবশ্যক। নৈতিক শিক্ষাকে কখনও অস্বীকার করা যায় না। প্লেটো এবং এরিস্টটলও এটিকে অস্বীকার করেননি। এরিস্টটলের মতে নৈতিকতা বিবর্জিত কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। তবে প্রশ্নের বিষয় হচ্ছে, কোনটি নৈতিক অথবা অনৈতিক এটি নির্ধারণ হবে কীভাবে? এরিস্টটলও এ বিষয়ে লম্বা আলোচনা করেছেন। হাল আমলে অমাদের শিক্ষাক্রমের নৈতিকতা বিষয়ক সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন এটি! কারণ একদিকে নৈতিকতার কথা বলা হলেও পাঠ্য পুস্তকের বিভিন্ন অধ্যায়ে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যা আমাদের সংস্কৃতি কখনই সমর্থন করে না। ফলে মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়টি সিলেবাসভুক্ত থাকলেও অভিভাবকদের মধ্যে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাদের আশঙ্কা এ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে যা আমদের সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। এর দ্বারা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় সংস্কৃতিও হুমকিতে পড়বে।
নতুন করিকুলামে কড়ষন-এর লার্নিং স্টাইল মূল সমস্যা নয়। বরং এটির মাধ্যমে যা শেখানো হচ্ছে সেটিই হচ্ছে মূল উদ্বেগের বিষয়। বুদ্ধিজীবীরা তত্ত্বের পাশাপাশি সংস্কৃতিও আমদানি করছেন; যা আগামী প্রজন্ম কে একটি ধর্মহীন, সেক্যুলার ও নৈতিকতাবিবর্জিত প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তুলবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়