নতুন বছরে শঙ্কার মাঝে আশা জাগে

নতুনের প্রতি মানুষের স্বাভাবিকভাবেই আকর্ষণ অনুভূত হয়। এ উপমহাদেশে মানুষের মাঝে নতুনকে বরণ করে নেয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহের কমতি থাকে না। বাস্তবতার নিরিখে পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে আসে নতুন দিন নতুন বছর। নতুনের আবাহন, স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারি আমাদের মধ্যে আসে। ২০২৪ সাল শুরুর লগ্নে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবেÑদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি স্থিতিশীল থাকবে? নির্বাচনী সহিংসতা সন্ত্রাস কোন মাত্রায় হবে? পশ্চিমা ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে কি? নতুন শ্রমনীতির টার্গেট কি বাংলাদেশ? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কি থামবে? দখলদার ইসরায়েলের ফিলিস্তিনে আগ্রাসন বন্ধ হবে কি? অর্থনীতিতে কি স্বস্তি ফিরবে? মূল্যস্ফীতি কি সহনীয় পর্যায়ে আসবে? ডেঙ্গুতে আর কত জীবন ঝরবে? রিজার্ভ আর ডলার সংকট কাটবে? ব্যাংক খাতে লোপাট আর অর্থ পাচার বন্ধ হবে? দুর্নীতির দৈত্যকে থামানো সম্ভব হবে? নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি আর সিন্ডিকেট ভাঙা কি আদৌও সম্ভব হবে?

৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশটি এবার ৫৩ বছরে পদার্পণ করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো আরও বেশ কিছু মেগা প্রজেক্টের কারণে অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নতির দিকে ধাবিত হয়েছে। দেশের কাঠামোগত উন্নয়নের ফলে দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান নিঃসন্দেহে উন্নত হয়েছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কিন্তু চারপাশে তাকালে আমরা যে উন্নয়ন প্রচেষ্টা দেখি, তারই মধ্যে আছে ব্যাপক দুর্নীতি, চুরি, চাঁদাবাজি ও কারচুপি। এসব যেন অগ্রগামী দেশটাকে পেছন থেকে দানবের মতো খামচে ধরেছে, আর অনেক ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছে। একদিকে নতুন নতুন উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে, কিন্তু এর বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির ব্যাপক প্রভাব। কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে স্বার্থান্বেষী মহল, যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন ঠিকই হচ্ছে, কিন্তু তার সুফল বেশি দিন পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশের রাস্তা, সেতু ও ভবন তৈরিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি বাজেট, খরচ করেও তা টেকসই ও উন্নত হচ্ছে না। ব্যাপক হারে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ফলে একদিকে অর্থের অপচয়, অন্যদিকে দেশের নাগরিকরা উন্নয়নের প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারছে না। অল্পকিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে, তারা দিনদিন দানবে পরিণত হচ্ছে, লাল-সবুজের প্রিয় স্বদেশকে তাদের আগ্রাসী থাবা থেকে মুক্ত করা হোক নতুন বছরের অঙ্গীকার।

বিদায়ী বছরের আলোচিত ঘটনা বিশ্বজুড়ে যুদ্ধবিদ্রোহ দ্বন্দ্ব-সংঘাত অর্থনৈতিক টানাপড়েন। সারা পৃথিবীর মতোই এ বছর আমরাও হারিয়েছি আমাদের জাতির নানা ক্ষেত্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সন্তানকে।

২০২৩ সালেও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে কারণে-অকারণে সংঘাত, সহিংসতা, নৃশংসতা, নির্মমতা ও রক্তাক্ত ঘটনা কম-বেশি প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে দেশবাসীকে। নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করছে। ব্যর্থতা, হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদক গ্রহণের প্রবণতা। পারিবারিক বন্ধন, আত্মীয়-স্বজন, স্নেহ-ভালোবাসা সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়ে গেছে উদ্বেগজনকভাবে। মার্কেট, শপিংমল প্রভৃতিতে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে অনেকগুলো, ব্যাপক ব্যবসায়িক ক্ষয়ক্ষতি হলেও এখনও কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন একটি রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ। এখানে থাকবে না কোনো শোষণ-অত্যাচার। কোনো হামলা, মিথ্যা মামলা, হানাহানি ও ধর্ষণ থাকবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি। আমরা চাই একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে মানুষে মানুষে সংঘাত থাকবে না। দিনদুপুরে খুন হবে না কেউ। আমাদের বোনরা ধর্ষণের শিকার হবে না। সব রাজনৈতিক দল তাদের ইচ্ছামতো রাজনীতি করতে পারবে। সব নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার থাকবে, বাকস্বাধীনতা থাকবে ভোটের অধিকার থাকবে। সন্ত্রাস-রাহাজানি থাকবে না। উৎপাদিত ফসলের যৌক্তিক মূল্য পাবে কৃষক। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে সক্ষম হবে। তাহলেই আমাদের দেশটা সোনার বাংলায় পরিণত হবে।

নতুন বছরে তারুণ্য জেগে উঠুক নব-উদ্যমে। নতুন বছরে তরুণরা নেতিবাচক বিষয়গুলো দূরে রেখে ইতিবাচক বিষয় খুঁজে বের করবে। নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গঠন করবে। বাস্তবতা যত বৈরী হোক তরুণ প্রজš§কে ধৈর্য ধরে তা মোকাবিলা করবে। ইংরেজি নববর্ষের এ সূচনালগ্নে সবার প্রত্যাশা জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা ও সফলতা আসুক। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সবার চেষ্টা সমৃদ্ধি বয়ে আনার। নতুনের মধ্যেই নিহিত থাকে অমিত সম্ভাবনা। আর সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপান্তরের সুযোগ করে দেবে নতুন বছর। যদিও প্রত্যাশা করা, স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবে রূপ দেয়া এক কথা নয়। তবে সঠিক পরিকল্পনা, সৎ সাহস, পরিশ্রম ও গঠনমূলক চিন্তার মাধ্যমে অবশ্যই সম্ভব কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা।

খালেদ সাইফুল্লাহ

শিক্ষার্থী, আইআইইউসি