বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণা

জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমিয়ে বাড়াল মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের  ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম মাথাব্যথার কারণ। তার তুলনায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা কম। তাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সাড়ে সাত শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি থাকার কারণে লক্ষ্যমাত্রা ছয় শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হলো।

অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি এবং বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া টাকা ও ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে শিগগিরই ক্রলিং পেগ নামে নতুন পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে এ পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার কত হবে, তা বলা হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতে এই ঘোষণা দিয়েছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান মুদ্রানীতির উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরেন এবং গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন মুদ্রানীতি তৈরি করা হয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ কমলেও অসুবিধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে মুদ্রানীতির ওপর একটা উপস্থাপনা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, প্রতিটি দেশই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, যার কারণে সবার প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে। বাংলাদেশের বেলায়ও তা কমানো হয়। বাংলাদেশ সরকারও জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ছয় শতাংশ হবে বলে আশা করছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির তীব্রতা সবাই যখন অনুভব করছে, তখন সবাই মূল্যস্ফীতি গুরুত্ব দিয়ে পলিসি রেট আগ্রাসীভাবে বাড়িয়েছে। তবে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আগ্রাসীভাবে বাড়িয়েছে। তাই আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশে নামবে বলে আশা করা যায়।

নতুন সরকারের সঙ্গে মুদ্রানীতি কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণÑএমন এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, নতুন সরকার রাজনৈতিক ১১টি নীতি নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে একটি ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। অন্যটি হলো ব্যাংক খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিত করা, যার দুটোতেই নতুন মুদ্রানীতিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কতটুকু সম্ভবÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখছে। অন্য বিষয়গুলো দেখার বিষয়ে নতুন অর্থমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। আগামী রোববার এ বিষয়ে তিনি একটি বৈঠক ডেকেছেন।

রিজার্ভের ওপর চাপ কমেছে কি নাÑএ প্রশ্নে গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশের চলতি হিসাব সবসময় নেগেটিভ থাকে। আর্থিক হিসাব সবসময় পজিটিভই থাকে। আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত দিয়ে ঘাটতি মেটানো হতো। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় রিজার্ভে যোগ হয় না। রিজার্ভে যোগ হয় আর্থিক হিসাবের উদ্বৃত্ত থেকে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে কড়াকড়ি করা হয়, যার কারণে চলতি হিসাব একটা সহনীয় পর্যায় চলে এসেছে। তবে আর্থিক হিসাব থেকে যে উদ্বৃত্ত আসত, সেটা গত অর্থবছর নেগেটিভ হয়ে গেছে। কারণ বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি ছিল, যার ফলে রিজার্ভ চাপে ছিল। তবে আমাদের বড় যেসব দায় রয়েছে, তার অধিকাংশ কমে গেছে। কয়েক মাসের মধ্যে ১০০ বা ২০০ মিলিয়নের মধ্যে নেমে আসবে। আর আর্থিক হিসাব যদি পজিটিভ পর্যায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করা যায়।’

নানা অনিয়মের পরও কেন ইসলামি ধারার এসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এবং গভর্নর চেয়ার হারানোর ভয় পাচ্ছেন কি নাÑএ প্রশ্নের জবাবে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমি অর্থসচিব ছিলাম। আমি নিয়মিত চাকরি ছেড়ে চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে এসেছি। আমি আগেও চলে যেতে পারি বা সরকার আমাকে চলে যেতে বলতে পারে। এখানে চেয়ার হারানোর কোনো ভয় নেই। সেই ভয় থাকলে অর্থ সচিবের চাকরি ছেড়ে এখানে আসতাম না। ভয়টয় পাই না। কেউ ভয় দেখালেও লাভ হবে না।’

তিনি বলেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাঠামোয় সমস্যা ছিল। সেখানে তারল্য সংকট হয়েছে অন্য কারণে, তাদের সুকুক বন্ড রয়েছে টোটাল ইসলামী ব্যাংকের দুই শতাংশ। অন্য ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট ছিল। তবে তাদের বন্ডে বিনিয়োগ থাকায় তারা টাকা পেয়েছে।

আর্থিক খাতের দুর্বলতার বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, আমরা আগেই দুর্বল ব্যাংকগুলো চিহ্নিত করেছিলাম। দেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, হবেও না। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে। তারা খারাপের দিকে যায়নি, আর দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবে।

নীতি সুদহার ফের বাড়ল

আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে আট শতাংশ করার ঘোষণা দেয়া হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। অন্যদিকে রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নি¤œসীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়। তবে নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফের (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সংকটে পড়া ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে। পাশাপাশি পলিসি রেটের যে করিডোর ছিল, তা দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে দেড় শতাংশ করা হয়েছে। গতকাল রাতেই নীতি সুদহার বৃদ্ধি নিয়ে একটি সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কমল সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি

নতুন মুদ্রানীতিতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। চলতি মুদ্রানীতিতে জুন পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১১ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এর মানে অর্জিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও কম ধরা হয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্য।

অন্যদিকে নতুন মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্তদ সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ, একই সময় পর্যন্ত চলতি মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩১ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এর বিপরীতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে ১৮ শতাংশ।

কমে যাবে টাকার প্রবাহ

চলতি মুদ্রানীতিতে আগামী জুন পর্যন্ত রিজার্ভ মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ছয় শতাংশ, যা নতুন মুদ্রানীতিতে কমিয়ে নেগেটিভ এক শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মানে আগামী ছয় মাসে নতুন টাকা ছাপিয়ে কোনো ঋণ বাড়াবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্যদিকে আগামী জুন পর্যন্ত চলতি মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০ শতাংশ, যা নতুন মুদ্রানীতিতে কমিয়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এর মানে আগামী ছয় মাসে বাজারে টাকার প্রবাহ আরও কমে যাবে।

বাড়তে পারে ব্যাংকঋণের সুদ

নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার আরও বাড়তে পারে। কারণ নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের খরচ আগের চেয়ে বাড়বে। আর ব্যাংকঋণের সুদ বাড়লে ঋণের চাহিদা কমে যায়। আর এ কারণেই নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে চার চ্যালেঞ্জ

আগামীতে সামস্টিক অর্থনীতিতে চারটি প্রধান চ্যালেঞ্জ দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা নতুন মুদ্রানীতিতে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো হলোÑমধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে জ্বালানি তেলের দামে অস্থিরতা; বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া; মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা; বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা এবং মন্দ ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন বা এনপিএল)।