নুসরাত জাহান পন্নি: গত কয়েক দশকে আমাদের কেনাকাটা করার অভ্যাসে বড় পরিবর্তন এসেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বেই এ পরিবর্তন লক্ষণীয়। আগের সময়কার সঙ্গে এখন কেনাকাটার মিল নেই।
ফ্যাশন বর্তমানে ব্যাপক সমৃদ্ধ ইন্ডাস্ট্রি। এটির বর্তমান মূল্য প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত ২৫ বছরে ২৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ব্যক্তিও একজন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মালিক।
১৯৮০ সাল পর্যন্ত ফ্যাশনের ৪টা মৌসুম (সিজন) ছিলÑ স্প্রিং (বসন্তকাল), সামার (গ্রীষ্মকাল), অটাম (শরৎকাল) এবং উইন্টার (শীতকাল)। তিন মাস পরপর আসা এই চার সময়ের মধ্যেই মানুষের কেনাকাটা মোটামুটি সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে এসেই এই ধারণা বদলে ফ্যাশনের ১২টি সিজন চলে এলো। আর সেই সঙ্গে তড়তড় করে বেড়ে গেল মানুষের কেনাকাটার মাত্রাও। উদ্যোক্তারা বুঝতে পারলেন যে, মুনাফা বাড়ানোর জন্য অল্প কিছু কালেকশন থাকাই যথেষ্ট নয়। কালেকশন যত বাড়বে বিক্রি তত বাড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে মুনাফাও। আর এভাবেই একটা নতুন ধারণা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে চলে এলো; যার নাম ফাস্ট ফ্যাশন। এটা পুরোটাই একটা পাশ্চাত্য ধারণা। এ ধারণায় ফ্যাশন জগতে একটা পোশাক যত তাড়াতাড়ি ট্রেন্ডে আসবে ঠিক তত তাড়াতাড়ি আবার ট্রেন্ড থেকে চলেও যাবে।
এর প্রভাব পুরো বিশ্বেই এখন লক্ষণীয়। ডধঃংড়হ ্ ডড়ষভব এর মতে, ২০০০ সালের দিকে ইউরোপে ফ্যাশন কোম্পানিগুলো প্রতি বছর ২টি ফ্যাশন কালেকশন প্রদর্শন করত। কিন্তু ২০১১ সালে এসেই এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ পর্যন্ত। এখন ঐ্গ-এর মতো কোম্পানি বছরে ১২-১৬টি ফ্যাশন শো করে থাকে। এছাড়া তধৎধ-এর মতো প্রতিষ্ঠান বছরে ২৪টি কালেকশন প্রদর্শন করে। অর্থাৎ আক্ষরিকভাবেই প্রতি ১৫ দিনে একেকটি ট্রেন্ড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকছে আবার বেরিয়েও যাচ্ছে।
এর বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন একজন গড় আমেরিকান ব্যক্তি বছরে প্রায় ৩০ কিলোগ্রাম কাপড় ফেলে দেন। টেক্সটাইল বর্জ্য উৎপাদন হয় বছরে ৯০ মিলিয়ন টন; যাতে ১ হাজার ৭০০টি টাইটানিক অনায়াসে ভরে ফেলা যায়। এছাড়া উত্তর চিলির আটাকামা মরুভূমিতে ৬০ হাজার টন কাপড়ের ভাগাড় আছে; যা কি না মহাকাশ থেকে দেখা যায়। এরকম একটা জায়গা কেনিয়াতেও পাওয়া যায়। এই কাপড়গুলো মোটেও নষ্ট হওয়া বা ফেলে দেয়া কাপড় নয়। এ কাপড়গুলোয় তেমন কোনো সমস্যা নেই, এগুলোর বেশিরভাগই একদম নতুন কাপড়। এই কাপড়গুলোর সমস্যা হলো, এগুলো কেউ কেনেনি। এর পেছনেও আছে ফাস্ট ফ্যাশন। এ কাপড়গুলো একসময় ট্রেন্ডি ছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই ট্রেন্ড পরিবর্তন হওয়ায় এই কাপড়গুলোর ভাগ্যে কোনো ক্রেতা জোটেনি।
শুধু ফেলে দেয়াই নয়, প্রতি বছর টনকে টন কাপড় পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে; যা কিনা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বড় বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। তাদের ডিজাইন যেন অন্য কোনো কোম্পানির হাতে না যায় সে জন্য তারা তাদের অবিক্রীত পোশাক রিসাইকল বা ডোনেট করার বদলে পুড়িয়ে ফেলে। যেমন এইচঅ্যান্ডএম কোম্পানি ২০১৩ থেকে প্রতি বছর ১২ টন কাপড় পুড়িয়ে ফেলে; যেগুলো কোনোভাবেই নষ্ট বা ফেলে দেয়া কাপড় নয়। যত নতুন কাপড় থাকবে ক্রেতা ততই ভাববে, এখনই এটা কিনতে হবে। নয়তো এই প্রোডাক্ট আউট অফ স্টক বা আউট অফ ট্রেন্ড হয়ে যাবে। এতে কী পরিমাণ পরিবেশের ক্ষতি হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ রকম একদম নতুন কাপড় ব্যাপক আকারে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে, কেবল টুকরা হওয়ার জন্য। এখানকার দেশগুলোর কারখানায় সারাবিশ্বের একদম নতুন কাপড়ের টুকরা করে সুতা বের করা হয়।
এছাড়া কাপড়ের গুণগত মানের দিক থেকেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগের তুলনায় এখনকার কাপড়ের মান ইচ্ছা করেই খারাপ করা হয়, যাতে মানুষ দ্রুত তার জামা পরিবর্তন করে। আগে যা ছিল টেকসই তা এখন ফাস্ট।
আমরা যে একটা কাপড় এত সময় ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছি আমাদের হয়তো খেয়ালই নেই যে কাপড় বানাতে শুধু টাকা নয়, পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ১০ শতাংশ এর জন্য দায়ী। এই ইন্ডাস্ট্রি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পানি গ্রাসকারী ইন্ডাস্ট্রি। ১টি কটনের টি-শার্ট তৈরি করতে ২৭০০ লিটার পানির প্রয়োজন পড়ে; যা একজন মানুষ সাধারণত ২.৫ বছরে পান করে। এছাড়া ১টি ডেনিম (জিন্স) প্যান্ট তৈরি করতে ততটুকু পানির প্রয়োজন হয়, একজন মানুষ ১০ বছরে পান করে। উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তানের মধ্যবর্তী আরল হ্রদের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একসময়কার পৃথিবীর বৃহত্তম হ্রদ ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে এখন প্রায় সম্পূর্ণ শুষ্ক হতে চলেছে।
শুধু উৎপাদনই নয়, কাপড়-চোপড় ওয়াশিং, ব্লিচিং, ডায়িং ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবশের আরও ক্ষতি হচ্ছে। কাপড়ে ব্যবহার করা রং কোনো প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই খাল, নদী বা সমুদ্রে পতিত হতে থাকলে এসব পানির রংও একসময় কালো হয়ে যায়। আমাদের ব্রহ্মপুত্র নদের দিকে তাকালেও আমরা এমনটাই দেখতে পাই। এর ফলে পানির নিচের শৈবাল সূর্যরশ্মির অভাবে সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না। আর এগুলো কেবল ছোট মাছের খাবারই নয়, বৈশ্বিক অক্সিজেনেরও একটা বড় উৎস।
কাপড়-চোপড় কেনা বা ফ্যাশনের প্রতি ঝোঁক থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু ফ্যাশন কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য আমাদের কাছে যে ফাস্ট ফ্যাশনের ধারণা নিয়ে এসেছে, তা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যদি একটা কাপড় বারবার পরি অর্থাৎ মোটামুটি ৬-৯ মাসের মতো পরি তাহলে পরিবেশের ক্ষতি ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনা যাবে। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। অল্পস্বল্প এদিক-সেদিক হলে সেগুলো ঠিক করে পরতেই পারি। এছাড়া পুরোনো কাপড় ফেলে না দিয়ে দুস্থদের দান করে দিতে পারি। এতে সমাজে একটা শৃঙ্খলাও বজায় থাকবে আবার পরিবেশের ক্ষতিও কম হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়