প্রতিনিধি, রাজশাহী : রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর চকরাজাপুর ইউনিয়নের ১৫টি চরে বসবাসকারী প্রায় তিন হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি। শত শত বিঘা জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। গত মঙ্গলবার মানিকের চরে বাদাম রক্ষার চেষ্টা করছেন চাষিরা। এই চরে শতাধিক পরিবার বাস করে, যারা এখন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এই পরিস্থিতি আরও ১৪টি চরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এদের প্রধান জীবিকা কৃষিকাজ, কিন্তু চারদিকে এখন শুধুই পানি। জমির ফসল সব পানির নিচে। পদ্মার ১৫টি চরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ বাস করে। চরের অধিকাংশ পরিবারই অন্যের জমি বার্ষিক ভাড়া নিয়ে বসবাস করে।
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পরিস্থিতি মনিটর করছে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বন্যার পানির কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যা সাহায্য কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর জন্য তারা আরও নৌকার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে।
এদিকে বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরের মানুষদের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অনেক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে গেছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিয়েছে।
চরের মানুষরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রæত সহায়তা চান। এখন তাদের জীবনের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো খাদ্য ও নিরাপদ পানির জোগান নিশ্চিত করা। স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা একসঙ্গে কাজ করে তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে। পদ্মার চরের মানুষের অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের জীবনযাত্রা পুনরুদ্ধার করতে সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনের আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
বাদামচাষিরা বলছেন, এই বন্যার কারণে তাদের সব ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। মূলত তারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং এটি তাদের প্রধান আয়ের উৎস। এখন সব জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা খুবই দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে তাদের পরিবার চরম কষ্টের মধ্যে রয়েছে। বন্যার পানি দ্রæত হ্রাস না পেলে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
বাদামচাষি বাবুল শেখ বলেন, মানিকের চরে ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছিলাম। এর মধ্যে তিন বিঘার বাদাম ওঠাতে পারলেও আরও তিন বিঘার বাদাম ওঠানোর আগে পদ্মায় পানি চলে এসেছে। এগুলো ওঠানোর চেষ্টা করছি। এর আগে শ্রমিকের খুব সংকটে রয়েছি। পানির কারণে আমাদের ফসল সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আয়ের প্রধান উৎস হলো কৃষি, কিন্তু এখন সবকিছু পানির নিচে। আমরা খুব কষ্টে আছি। এদিকে রাসেলস ভাইপারের ভয়ে শ্রমিকরা কাজ করতে চায়নি। ফলে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। তবে তিন বিঘা জমির বাদাম এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে।
এই চরের আজগর আলী বলেন, আমি, আমার স্ত্রী ও দুই ছেলে মিলে অন্যের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে দুটি ঘর তৈরি করে বসবাস করছি। তবে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমরা চরম বিপদে আছি। আমাদের ছাগল ও গরুর জন্য কোনো জায়গা নেই। বর্তমানে কৃষিকাজও বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের জীবিকা নির্বাহ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। আমি মাঝে মাঝে জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করি এবং তা বিক্রি করে কিছু টাকা উপার্জন করি। কিন্তু এই সামান্য আয় দিয়ে আমাদের সংসার চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের জীবনযাত্রা এখন চরম বিপর্যস্ত। আমরা জানি না কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেব। আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে সরকারের সহায়তা।
চকরাজাপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর জালাল উদ্দিন বলেন, পদ্মার চরের মধ্যে মানিকের চর, দিয়ারকাদিরপুর, টিকটিকিপাড়া চরসহ চকরাজাপুর ও কালিদাসখালির কিছু অংশ নিয়ে চকরাজাপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। এই ওয়ার্ডে পরিবার রয়েছে তিন শতাধিক। ভোটার রয়েছে এক হাজার ৩৫ জন। চরের অধিকাংশ জমি নিচু ও ফসলি। জমিতে রোপণ করা বাদাম ও পাটের ব্যাপক ক্ষতি হবে। অধিকাংশ জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আজিযুল আযম বলেন, পদ্মার চরে প্রায় তিন হাজার পরিবার রয়েছে। তারা এখন পানিন্দি। চরের অধিকাংশ বাড়ির পাশে পানি এসেছে। ৪৭৩ হেক্টর জমির মধ্যে অর্ধেক বাদাম ওঠাতে পারেননি চাষিরা। সেই বাদাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেকেই পানির নিচে ডুব দিয়ে বাদাম ওঠাচ্ছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, চাষিরা জমি থেকে কিছু বাদাম ওঠাতে পারেননি, কারণ তাদের জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে কিছু পাটের আবাদ বেঁচে রয়েছে। বাদামের চাষ হয়েছে ৪৭৩ হেক্টর এবং পাটের আবাদ হয়েছে চার হাজার ৭৮০ হেক্টর। এই অবস্থার পরিস্থিতিতে বাদামচাষিরা অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছেন এবং তাদের জীবিকা প্রভাবিত হয়েছে।