পুরোনো প্যাকেটে নতুন দামে বিক্রি

বিএটির রাজস্ব ফাঁকি ২১০.৮৬ কোটি টাকা

রহমত রহমান: উচ্চস্তরের সিগারেট। প্যাকেট পুরোনো, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে। প্রতি প্যাকেটে সরকার হারাচ্ছে ১৪-১৫ টাকা রাজস্ব। একইভাবে নিম্নস্তরের সিগারেটও পুরোনো প্যাকেট, নতুন দামে বিক্রি হচ্ছে, যাতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১০-১১ টাকা। বাজেট ঘোষণা হয় ৬ জুন। কিন্তু ৫ জুনের আগেই বিপুল পরিমাণ সিগারেট ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে, যা বাজেটের পরপর বাজারে ছাড়া হয়েছে। সরকারকে পুরোনো প্যাকেটের রাজস্ব দেয়া হলেও বেশি দামে বিক্রির ওপর কোনো রাজস্ব দেয়া হয়নি। এতে শুধু ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ২১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-মূল্য সংযোজন করের যাচাইয়ে এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। শুধু বিএটি নয়, বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি জেটিআইর প্রায় ১৩ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এরই মধ্যে বিএটিকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের দাম বা রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। সিগারেট কোম্পানিগুলো বিশেষ করে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটি দাম বা মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নেয়। বাজেটের কয়েক মাস আগ থেকে সিগারেটের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি উৎপাদিত সিগারেট ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মজুত করা হয়। বাজেট ঘোষণার পরপরই কম দামের সেই সিগারেট বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হয়। এই বিক্রি চলে অন্তত চার-পাঁচ মাস। পুরোনো এসব সিগারেটের ওপর বাড়তি কোনো রাজস্ব পায় না এনবিআর। এই নিয়ে দৈনিক শেয়ার বিজ অনুসন্ধানে নামে। চলতি বছরের ২৭ জুন দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকায় ‘পুরোনো প্যাকেটে নতুন দামে বিক্রি—এক চিঠিতেই বিএটির পকেটে ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এলটিইউ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। ৫ জুনের পরে ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বিক্রি, সেই সিগারেট ও বর্ধিত দামে বিক্রির বিষয়ে তথ্য চেয়ে এলটিইউ বিএটিকে চিঠি দেয়। একইসঙ্গে বাজেট-পরবর্তী বেশি দামে সিগারেট বিক্রির বিষয়ও খতিয়ে দেখে এলটিইউ। পরে বিষয়টি জানিয়ে ও মতামত চেয়ে এনবিআরের দুই সদস্যকে (মূসক নীতি, মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) এলটিইউ থেকে চিঠি দেয়া হয়। পরে এনবিআর থেকে বলা হয়, বর্ধিত দামের উপর প্রযোজ্য হারে শুল্ককর আদায় করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এলটিইউ যাচাই শেষে ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর বিএটিকে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে এলটিইউ।

অপরদিকে এলটিইউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্কহার পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে সর্তকর্তামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৫ জুন মূসক কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের সিগারেটের উৎপাদনস্থল বা কারখানায় গিয়েছে। সেখান থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউস বা ডিপোর তথ্য নিয়ে আসে। ৬ জুন বাজেট ঘোষণা হয়। ওই দিন থেকে সিগারেটের স্তরভিত্তিক মূল্য ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। এই বর্ধিত মূল্যের ভিত্তিতে প্রযোজ্য শুল্ককর আরোপযোগ্য হবে। ওয়্যারহাউস বা ডিপোতে ৫ জুন পর্যন্ত মজুতকৃত সিগারেট ক্রেতার কাছে (ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর) কোন মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং কী হারে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছে—এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে বিএটিকে লিখিত বক্তব্য, হিসাব বিবরণী ও দলিলাদি দিতে তিন দিনের সময় দিয়ে এলটিইউ থেকে ১৪ জুলাই চিঠি দেয়া হয়। তবে প্রতিষ্ঠান ৩০ দিনের সময় চাইলে সাত দিন সময় দেয়া হয়। তবে ৩০ জুলাই একটি হিসাব বিবরণী জমা দেয়। কিন্তু ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরদের কোন মূল্যে সিগারেট সরবরাহ এবং কী হারে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছে—তার কোনো তথ্য বা প্রমাণক দেয়নি বিএটি।

সূত্রমতে, সিগারেট নিয়ে এনবিআর ২০১৯ সালের ১৩ জুন একটি এসআরও (এসআরও নং-১৮১) জারি করেছে, যাতে অনুচ্ছেদ ৪(৩)-এর বিধি অনুযায়ী, সিগারেট উৎপাদনের কারখানা থেকে সিগারেটের প্রতিটি অপসারণই সরবরাহ হিসেবে বিবেচিত। তবে অনুচ্ছেদ ৪(১) অনুযায়ী, নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে সিগারেট বিক্রয় বা সরবরাহের সুযোগ নেই। আবার ২০২০ সালের অপর এক এসআরও (এসআরও নং-১৪৭) অনুযায়ী, সিগারেটের স্থানীয় সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর প্রযোজ্য হারে উৎপাদনস্থল থেকে সরবরাহের সময় মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করতে হবে এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো পর্যায়েই সিগারেট বিক্রি করা যাবে না। অর্থাৎ উপাদনস্থল থেকে যে মূল্যের ওপর মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয়েছে—সেই মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে সিগারেট সরবরাহ করা হলে সেই অধিক মূল্যের ওপর মূসক ও সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ জুন থেকে সিগারেটের স্তরভিত্তিক বর্ধিত মূল্য ও বর্ধিত সম্পূরক শুল্কহার কার্যকর হয়েছে। ৫ জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউসে মজুত সিগারেট সেই বর্ধিত মূল্যে বিক্রি হওয়ায় বর্ধিত মূল্য ও বর্ধিত সম্পূরক শুল্কহারে প্রদেয় শুল্ককর পরিশোধযোগ্য হবে। প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা হিসাব বিবরণী অনুযায়ী ৫ জুন পর্যন্ত মজুতকৃত সিগারেট ৬ জুন থেকে সরবরাহ-সংক্রান্ত মূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমন—৫ জুন পর্যন্ত বিএটির বেনসন হেজেজ ব্লু গোল্ড লিফ (২০ শলাকা), বেনসন অ্যান্ড হেজেজ সুইস, বেনসন হেজেজ ফিউশন, বেনসন হেজেজ ব্রিজ, বেনসন হেজেজ বিজি বক্স আউটার, বেনসন হেজেজ ব্লু গোল্ড (১২ শলাকা), বেনসন হেজেজ এসএফ, বেনসন হেজেজ নেকড ওয়ারফ প্রতি ১০০০ শলাকার মূল্য ঘোষণা করেছে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। আর ৬ জুন থেকে এই প্রতি ১০০০ শলাকার সরবরাহ মূল্য হয় ১৫ হাজার ৯৯৬ টাকা ২৭ পয়সা। অর্থাৎ ১০০০ শলাকার বাড়তি মূল্য দিতে হয় ৪৯৬ টাকা ২৭ পয়সা। একইভাবে বেনসন হেজেজ আলকেমি প্রতি ১০০০ শলাকা ১৬ হাজার টাকা, যা ৬ জুন থেকে ৯৯৬ টাকা ২৭ পয়সায় সরবরাহ হয়। একইভাবে জন প্লেয়ার স্পেশাল, জন প্লেয়ার গোল্ডলিফ, জন প্লেয়ার সুইস, ক্যাপাসটন, লাকি স্টাইকের পাঁচটি ব্র্যান্ড, স্টার ফিল্ডারের তিনটি ব্র্যান্ড, পাইলট, ডারবি, হলিউড একইভাবে বাড়তি দামে সরবরাহ করে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ জুন পর্যন্ত এবং ৬ জুন থেকে কার্যকর মূল্য, শুল্ককরের পার্থক্যজনিত পরিহারকৃত মূসকের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ৬ জুন থেকে বিএটির ব্র্যান্ড বেনসন অ্যান্ড হেজেজ বিজি ব্লাক আউটার ২০ শলাকার সিগারেট সরবরাহ করা হয়েছে ২১ লাখ ৪০ হাজার শলাকা। এই ২০ শলাকার সিগারেটের দাম ৩২৪ টাকা, যাতে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক ২১২ টাকা ২২ পয়সা, মূসক ৪৮ টাকা ৬০ পয়সা, সারচার্জ ৩ টাকা ২৪ পয়সা। ফলে ২১ লাখ ৪০ হাজার শলাকার ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক দুই কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার ৫৪০ টাকা, মূসক ৫২ লাখ টাকা ও সারচার্জ তিন লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা। মোট শুল্ককর দুই কোটি ৮২ লাখ ৫৪ হাজার ৪২০ টাকা। একইভাবে একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি ৩৭টি ব্র্যান্ডের সিগারেট সরবরাহ করেছে ৫৩৯ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৪৬০ শলাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর তিন হাজার ২৫৫ কোটি ৫২ লাখ এক হাজার ৪২৭ টাকা।

অপরদিকে ৫ জুন পর্যন্ত বেনসন অ্যান্ড হেজেজ বিজি বক্স আউটার ২০ শলাকা সরবরাহ হয়েছে ২১ লাখ ৪০ হাজার। ২০ শলাকার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৫৬ শতাংশ। ৩১০ টাকা মূল্যের এই সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ২০১ টাকা ৫০ পয়সা, মূসক ৪৬ টাকা ৫০ পয়সা ও সারচার্জ তিন টাকা ১০ পয়সা। সে অনুযায়ী সরবরাহ করা এই সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর দাঁড়ায় দুই কোটি ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭০০ টাকা। আবার বাজেটের পরে বেনসন অ্যান্ড হেজেজ বিজি বক্স আউটার ওপর শুল্ককর বেড়েছে ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৭২০ টাকা। ৫ জুন পর্যন্ত কার্যকর মূল্যের ভিত্তিতে ৩৭টি ব্র্যান্ডের সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য মোট শুল্ককর তিন হাজার ৪৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬ টাকা। অর্থাৎ এই টাকা পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠান ওয়্যারহাউস থেকে সিগারেট বের করেছে।

আবার ৬ জুন থেকে ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউরদের কাছে বর্ধিত মূল্যে সরবরাহ করা ৪১টি ব্র্যান্ডের সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর দাঁড়ায় ৩২৫৫ কোটি ৫২ লাখ এক হাজার ৪২৭ টাকা। সে অনুযায়ী বর্ধিত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে ২১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৭ হাজার ১০৬ টাকা বেশি নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ৫ জুনের আগের সিগারেট মজুত করে রাখা হয়েছে, যা ৬ জুনের পর বিক্রি করা হয়েছে, যাতে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। মূসক আইনের ১২৭(১) অনুযায়ী দাবি করা রাজস্ব পরিশোধের পূর্ব দিন পর্যন্ত প্রযোজ্য হারে সুদ আদায়যোগ্য হবে। সুদ যোগ করা হলে ফাঁকির পরিমাণ বাড়বে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে বিএটির দুই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো জবাব দিতে রাজি হননি।