তৈয়ব আলী সরকার, নীলফামারী: আগাম আলু চাষের ভাণ্ডার উত্তরের সীমান্তঘেঁষা জেলা নীলফামারী। এর মধ্যে অন্যতম সদরের কচুকাটা ইউনিয়নের কচুকাটা গ্রাম। গ্রামটি আলু চাষে খ্যাত হওয়ায় আলু গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এডোম চায়না জাতের ধান কেটে মাঠের পর মাঠ সেভেন জাতের আলু চাষে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক পরিস্যংখানে জানায়, জেলার ছয় উপজেলায় এবার সাত হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেভেন জাতের আলু রোপণ করা হয়েছে (চলমান)। তবে গত বছর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাত হাজার ৫২০ হেক্টর। হিসাবমতে, এবার অতিরিক্ত ২৮০ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হচ্ছে।
স্বল্পমেয়াদি আগাম আউশ ও স্থানীয় চায়না জাতের ধান কাটা ও মাড়াই শেষে ওই জমিতে মাঠজুড়ে সেভেন জাতের আলু রোপণ চলছে। এজন্য বীজ সংগ্রহ, জমি প্রস্তুত, সার প্রয়োগসহ আলু চাষে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক। বিশেষ করে কচুকাটা গ্রামের উত্তর পাড়া, কচুকাটা বন্দর পাড়া, পূর্ব পাড়া, ভরট পাড়া, গুড়গুড়ী, চেয়ারম্যান পাড়া, নোহালীর ডাঙ্গা ও চৌধুরী পাড়ায় আগাম আলু রোপণকে ঘিরে কৃষকের মাঝে খুশির জোয়ার রইছে। তাই কচুকাটা গ্রামটি এখন আলুর গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দ্বিগুণ লাভের আশায় মাঠে মাঠে চলছে এখন আলু রোপণ ও জমি প্রস্তুতের কাজ। জমি তৈরি, আইল তৈরি, আগাছা পরিষ্কার, বীজ সংগ্রহ ও সার প্রয়োগ নিয়ে ব্যস্ত তারা। দম ফেলার নেই ফুরসত।
কচুকাটা বন্দর পাড়া গ্রামের আলুচাষি বজলুর রশিদ বলেন, এবার দুই বিঘা জমিতে আগাম আলু রোপণ করেছি। তিনি বলেন, সার, বীজ, পরিবহন, লেবার, বালাইনাশক ও ছত্রাকনাশকসহ আলু ঘরে তোলা পর্যন্ত মোট খরচ হবে প্রায় এক লাখ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ওই দুই বিঘায় আলু উৎপাদন চার হাজার কেজি। বাজার দর প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হলে লাভ হবে দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। আশা করি, খরচ বাদে আমার লাভ হবে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া আরও এক বিঘা জমিতে সেভেন জাতের আলু রোপণের প্রস্তুতি চলছে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গতবারের চেয়ে ভালো ফলনের আশায় কোমর বেঁধে আলু রোপণ করছি। স্বল্পমেয়াদি (৫৫-৬০ দিন) আগাম জাতের আলু চাষে লাভবান হওয়া যায়।
একই গ্রামের আলুচাষি আব্দুস সালাম বলেন, গতবারের চেয়ে এবার চার বিঘা জমিতে সেভেন জাতের আলু চাষ করছি। এ গ্রামের সবাই আলুচাষি। এখানকার মাটি উর্বর হওয়ায় আলু চাষের জন্য খুবেই উপযোগী। চায়না জাতের আগাম ধান কেটে আলু রোপণ করে থাকি। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সবাই কোমর বেঁধে আলু চাষে ঝুঁকছে। তিনি বলেন, অন্য ফসলের চেয়ে আগাম আলু চাষ একটি লাভজনক ফসল। ফলন ভালো হলে আমার চার বিঘায় খরচ বাদে লাভ হবে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা।
এলাকার আলুচাষি আশরাফুল ইসলাম জানান, সেভেন জাতের তিন বিঘা জমিতে আলু লাগিয়েছি। এ এলাকার মাটি উঁচু ও বালুমিশ্রিত বেলে দো-আঁশ হওয়ায় বন্যা ও খরায় আলুর ক্ষতি হয় না। ফলনও ভালো হয়। এখানকার আলু ক্রয়ে মহাজনরা আগাম বায়না দিয়ে যায়। উৎপাদিত আলু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চড়া দামে (৮০-১০০ কেজি) বিক্রি করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। ধান, পাট, ভুট্টা, গমÑএসব ফসলের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগাম আলু চাষের বিকল্প নেই।
ওই ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক জানান, এই অঞ্চলের মাটি দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ হওয়ায় আগাম জাতের আলু চাষের জন্য উপযোগী। কচুকাটা গ্রামে ১০ অক্টোবরের পর থেকে আলু রোপণ শুরু হয়েছে। গ্রামটিতে সেভেন জাতের ৩০ হেক্টর (২২৫ বিঘা) জমিতে আলুর চাষ হচ্ছে। এসব আলু ডিসেম্বরের ১০-১৫ তারিখের মধ্যে কৃষক ঘরে তুলতে পারবে। বাজারদর ৬০-৭০ টাকার মধ্যে থাকলে বিঘায় যা খরচ করছে তার দ্বিগুণ লাভ হবে। এছাড়া আলুর মৌসুমে বিএডিসির সান সাইন নামের উন্নত জাতের আলু বীজ রোপণের উদ্বুদ্ধ করছি। এই আলুর বীজ সেভেন জাতের আলুর চেয়েও বেশি ফলন দেয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠনো সম্ভব।
সদর উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা বকুল ইসলাম বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করা সম্ভব হবে। কৃষক আগাম আলু চাষ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সদরের কচুকাটা গ্রামের মাটি উর্বর হওয়ায় আগাম আলু চাষের জন্য খুবেই উপযোগী। ওই গ্রামে ২২৫ বিঘা জমিতে আলুর চাষ হচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কৃষক ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তিনি বলেন, এ বছর জেলায় সাত হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আশা করি, গত বছরের চেয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।