আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের প্যাকেজ অনুমোদন করলেও এর প্রতিটি কিস্তি শর্তসাপেক্ষ। ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ঋণ কর্মসূচি চালু হওয়ার পর আইএমএফ থেকে তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। এরই মধ্যে দুটি কিস্তি ছাড় পেয়েছে বাংলাদেশ; তবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে পেতে বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশকে। আইএমএফ চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির জন্য কিছু কঠোর শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশকে, যা একদিকে যেমন অর্থনৈতিক সংস্কারকে ত্বরান্বিত করবে, অন্যদিকে নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
আইএমএফের প্রধান শর্ত: ক. রাজস্ব আদায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি, খ. ব্যাংক খাতের সংস্কার, গ. শক্তি খাতে ভর্তুকি হ্রাস, ঘ. বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে আরও নমনীয় করা, ঙ. দুর্বল রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন, চ. এনপিএল (খেলাপি ঋণ) কমানো এবং ভ্যাট ও কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।
শর্তগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য: বর্তমান প্রেক্ষাপটে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে ঘাটতি রয়েছে। কর নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার না এনে তাৎক্ষণিক রাজস্ব বাড়ানো বেশ কঠিন হবে। অপরদিকে, ব্যাংকিং খাতে বেসরকারি খাতের আস্থা সংকট, পরিচালনা ব্যর্থতা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এখনও একটি বড় সমস্যা। তবে সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপও নিয়েছেÑবিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো হয়েছে, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে এবং ভ্যাট ব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি: এনবিআরের রাজস্ব আহরণে ঘাটতি রয়ে গেছে। তবে এটি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নয়, বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করে। সরকার যদি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার বাস্তবায়ন করে; তবে এটি রাজস্ব আহরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ব্যাংক খাতের সংস্কার: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে নানা সংকটে জর্জরিত। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদান ক্ষমতা কমে গেছে এবং সরকারের ওপর চাপ পড়েছে। এই সংকট মোকাবিলা করতে আইএমএফ ব্যাংক খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, বিশেষ করে খেলাপি ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে। তবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভাবে এ সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা: আইএমএফ চাচ্ছে, বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে আরও নমনীয় ও বাজারভিত্তিক করতে। এই শর্তটি বাস্তবায়ন হলে তা একদিকে যেমন মুদ্রার বাজারকে স্বাভাবিক করবে, অন্যদিকে এটি রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সংকটও দূর করতে সাহায্য করবে। তবে দেশের দুর্বল রিজার্ভ পরিস্থিতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহের কমতি শর্ত পূরণের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভর্তুকি কমানো এবং শক্তি খাতের সংস্কার: আইএমএফ বাংলাদেশকে শক্তি খাতে ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে, যা সরকারের জন্য একটি কঠিন সিদ্ধান্ত হতে পারে। দেশের বৃহত্তম জনগণের জন্য শক্তি খাতে ভর্তুকি কমালে, তা সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে। তবে শক্তি খাতের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নতি নিশ্চিত করতে ভর্তুকি কমানোর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
বাজেট ম্যানেজমেন্ট এবং জনসাধারণের আস্থা তৈরি: স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনা এবং জনসাধারণের আস্থা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। দুর্নীতি ও অকার্যকর ব্যবস্থাপনার ফলে দেশের অর্থনীতির উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়, যা ঋণের শর্ত পূরণের পথে একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা: আইএমএফের শর্ত পূরণে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য উপযুক্ত সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি; যাতে শক্তি খাতে ভর্তুকি কমানোর ফলে তাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা না পড়ে। সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে সামাজিক অস্থিরতা কমে যাবে এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সম্ভব হবে।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির শর্ত পূরণ সম্ভব, তবে তা নির্ভর করছে সরকারের নীতিগত অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের দৃঢ়তার ওপর। যদি বাংলাদেশ এই কিস্তি ছাড় না পায়, তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও সংকুচিত হবে, যা আমদানি ব্যয় মেটানো, ঋণ পরিশোধ, এমনকি রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ ব্যর্থ হলে জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ বাড়বে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট দেখা দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পেতে বাংলাদেশের সামনে মোটাদাগে তিনটি বাধা রয়েছে। এসব বাধা অতিক্রম করতে না পারলে আইএমএফের কিস্তি পাওয়া কঠিন হবে। এগুলো হলোÑমুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব আদায় ও এনবিআরের রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে আলাদা করা।
এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ একটাইÑস্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং সাহসী আর্থিক সংস্কার। সুশাসন নিশ্চিত করে, ভর্তুকিভিত্তিক খাতকে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থায় রূপান্তর করে এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কার্যকর নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ কেবল আইএমএফ নয়, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতেও নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে।
জোলেখা আক্তার জিনিয়া
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা